কৃত্রিম উপায়ে তৈরি ভ্রূণ মডেল নিয়ে বাড়ছে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ, বাড়ছে উদ্বেগও।
বিজ্ঞানীরা এখন মানুষের জীবন কীভাবে শুরু হয়, সেই প্রক্রিয়াটি পরীক্ষাগারে তৈরি করার চেষ্টা করছেন। ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু ছাড়াই তারা স্টেম সেল (stem cell) ব্যবহার করে মানব ভ্রূণের মতো গঠন তৈরি করছেন। এই সেলগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কোষে পরিণত হতে পারে।
বর্তমানে তৈরি হওয়া এই ভ্রূণ মডেলগুলো এখনো পর্যন্ত হুবহু আসল ভ্রূণের মতো নয়। তবে, বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত এই মডেলগুলোকে উন্নত করার চেষ্টা করছেন। তারা এমন কাঠামো তৈরি করতে চাইছেন যা দেখতে এবং আচরণে অনেকটা আসল ভ্রূণের মতোই হবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই মডেলগুলি মানবদেহের বৃদ্ধি এবং বন্ধ্যাত্বের কারণ অনুসন্ধান করতে সাহায্য করবে। কিন্তু গবেষণা দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলায় এর নৈতিক, আইনগত এবং সামাজিক দিকগুলো নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তা অভাবনীয়। তবে, মডেলগুলো উন্নত হওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানসম্মত অগ্রগতির পাশাপাশি নৈতিক, আইনগত এবং সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
ড. ক্লার্ক বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্টেম সেল গবেষণা সংস্থার (International Society of Stem Cell Research – ISSCR) ভ্রূণ মডেল বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের সহ-সভাপতি হিসেবে কাজ করছেন। এই গ্রুপ বিশ্বজুড়ে এই সংক্রান্ত একটি কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করছে। তাদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা এই স্টেম সেলগুলো নিয়ে ঠিক কতদূর যেতে পারবেন।
সময়ের সাথে সঠিক পরিবেশ তৈরি করতে পারলে, বিজ্ঞানীরা কি এমন একটি মডেল তৈরি করতে পারবেন যার হৃদস্পন্দন থাকবে, যা ব্যথানুভব করতে পারবে এবং যা একটি পূর্ণাঙ্গ মানব রূপে বিকশিত হতে পারবে?
বর্তমানে তৈরি হওয়া কোনো মডেলই মানব ভ্রূণের সম্পূর্ণ বিকাশের প্রক্রিয়াটি অনুকরণ করতে পারে না। এমনকি কোনো মডেলের মধ্যে ভ্রূণ থেকে মানব শিশু (fetus) তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তবে, মডেলগুলোতে ভ্রূণের কিছু অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য, যেমন – অ্যামনিয়ন, ইয়োক স্যাক এবং আদিম রেখা (primitive streak) দেখা যায়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভবিষ্যতে উন্নতির মাধ্যমে এই মডেলগুলোতে হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অঙ্গের প্রাথমিক রূপ (rudiments) তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। ইঁদুরের কোষ দিয়ে তৈরি করা কিছু মডেলে ইতিমধ্যে মস্তিষ্কের বিকাশ এবং হৃদপিণ্ডের গঠন দেখা গেছে।
গবেষকদের মূল লক্ষ্য হলো, এই মডেলগুলোকে মানুষের অনুভূতি সম্পন্ন কোনো ভ্রূণে পরিণত করা নয়। বরং, তারা এমন একটি গবেষণা সরঞ্জাম তৈরি করতে চান যা মানব কোষ কীভাবে বিভাজিত হয় এবং একটি মানবদেহ তৈরি করে, সেই রহস্য উন্মোচন করতে পারবে। এই মডেলগুলোর মাধ্যমে এমন কিছু পরীক্ষা করা সম্ভব, যা সরাসরি মানব ভ্রূণের উপর করা যায় না।
তবে, গবেষণা যত এগোবে, পরীক্ষাগারে তৈরি মডেল এবং জীবিত মানব ভ্রূণের মধ্যেকার পার্থক্য হয়তো কমে আসবে।
স্টেম সেল জীববিজ্ঞান এবং ভ্রূণবিদ্যা – এই দুটি বিষয়ই বিতর্কিত। তাই, অন্যান্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার চেয়ে এই ধরনের গবেষণার ক্ষেত্রে আরও বেশি নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতিমধ্যে, আন্তর্জাতিক স্টেম সেল গবেষণা সংস্থা (ISSCR) এই মডেলগুলোর উপর গবেষণা বিষয়ক তত্ত্বাবধান বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। সংস্থাটি তাদের নির্দেশিকা (guidelines) সংশোধন করছে এবং খুব শীঘ্রই নতুন সংস্করণ প্রকাশ করা হবে।
নতুন নির্দেশিকায় ভ্রূণের সম্পূর্ণ প্রতিরূপ তৈরি করা মডেল (integrated embryo models) এবং ভ্রূণের একটি অংশ তৈরি করা মডেলের (non-integrated models) মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, উভয় প্রকার মডেলের গবেষণা “উপযুক্ত নৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার” অধীনে আনতে হবে।
নতুন নির্দেশিকায় দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে: প্রথমত, মানব ভ্রূণ মডেলকে কোনো মানুষ বা পশুর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানীরা মানব ভ্রূণ মডেল ব্যবহার করে কৃত্রিম জরায়ুর (artificial womb) মাধ্যমে ভ্রূণের বর্ধন (ectogenesis) প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই স্টেম সেল-ভিত্তিক ভ্রূণ মডেলগুলোকে আসল মানব ভ্রূণের গবেষণা থেকে আলাদা করে দেখা উচিত। কারণ, আসল ভ্রূণের উপর গবেষণা অনেক দেশেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, আবার কোনো কোনো দেশে এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
তবে, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক আইনের অধ্যাপক এমা কেভ মনে করেন, মডেল এবং আসল ভ্রূণকে এখনই একইভাবে বিচার করার প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক হীরা এবং পরীক্ষাগারে তৈরি হীরার উপাদান একই হলেও, সমাজের চোখে তাদের মূল্য ভিন্ন।
তিনি আরও বলেন, এই গবেষণাকে দ্রুত নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করা হলে, তা হয়তো সম্ভাবনাময় অনেক গবেষণা বন্ধ করে দেবে।
বর্তমানে, বিভিন্ন দেশে ভ্রূণ মডেলের উপর নজরদারির ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুযায়ী, ভ্রূণ মডেলকে মানব ভ্রূণের মতোই বিবেচনা করা হয় এবং গবেষণার জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। নেদারল্যান্ডস-এও (Netherlands) ২০২৩ সালে “অ-প্রথাগত ভ্রূণ”-কে মানব ভ্রূণের সমতুল্য হিসাবে বিবেচনা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে (UK) বিজ্ঞানীরা একটি স্বেচ্ছাসেবী আচরণবিধি প্রকাশ করেছেন, এবং জাপানও এই বিষয়ে নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে (US) ভ্রূণ মডেলগুলি কোনো নির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। এখানে প্রতিটি গবেষণা প্রস্তাবনা পৃথক প্রতিষ্ঠান এবং তহবিল প্রদানকারী সংস্থাগুলি বিবেচনা করে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (National Institutes of Health) জানিয়েছে, তারা এই ধরনের গবেষণা প্রস্তাবগুলো স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করবে এবং মডেলগুলির ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করবে।
তবে, আন্তর্জাতিক নির্দেশিকাগুলো এখনো পর্যন্ত অনেক প্রভাবশালী। কারণ, অনেক দেশেই এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, একটি ভ্রূণ মডেল কখন এবং কীভাবে মানব ভ্রূণের মতোই কার্যকরী হবে, তা বোঝা। কারণ, সেই মুহূর্তে সম্ভবত এটিকে মানব ভ্রূণের মতোই সুরক্ষা দিতে হবে।
ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের (The Francis Crick Institute) ডেভেলপমেন্টাল মডেলস ল্যাবরেটরির গ্রুপ লিডার নাওমি মরিস মনে করেন, পরীক্ষাগারে তৈরি মডেল এবং মানব ভ্রূণের মধ্যেকার পার্থক্য নির্ধারণের জন্য কিছু “পরীক্ষা” (Turing test) প্রয়োজন। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারবেন, একটি মডেল মানব ভ্রূণের কাছাকাছি পৌঁছেছে কিনা।
প্রথম পরীক্ষায় দেখা হবে, মডেলগুলো নিয়মিতভাবে তৈরি করা যাচ্ছে কিনা এবং স্বাভাবিক ভ্রূণের মতো একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিকশিত হচ্ছে কিনা। দ্বিতীয় পরীক্ষায়, পশু স্টেম সেল থেকে তৈরি ভ্রূণ মডেল – বিশেষ করে বানরের মতো মানব-সদৃশ প্রাণীর মডেল – কোনো পশুর জরায়ুতে প্রতিস্থাপনের পর জীবিত এবং প্রজননক্ষম প্রাণী তৈরি করতে পারে কিনা, তা দেখা হবে। যদি এটি সম্ভব হয়, তবে মানব ভ্রূণ মডেলের ক্ষেত্রেও একই ফল পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মডেলগুলো মানব ভ্রূণের তুলনায় বেশি কার্যকর এবং নৈতিক বিকল্প হতে পারে। এর মাধ্যমে বন্ধ্যাত্ব (infertility) বিষয়ক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করা যেতে পারে। এছাড়া, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ওষুধ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও এই মডেলগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, এই মডেলগুলো জীবন তৈরির কাজে ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে অনেকে উদ্বিগ্ন। কারণ, এর মাধ্যমে পরীক্ষাগারে ভ্রূণ তৈরি করে বিভিন্ন বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির মাধ্যমে সেটিকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করা হতে পারে।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Texas) মলিকুলার বায়োলজির সহযোগী অধ্যাপক জুন উ-এর মতে, বিজ্ঞানীরা ভ্রূণ মডেল তৈরির সময় একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। মডেলগুলোকে মানব ভ্রূণের রহস্য উন্মোচন করার জন্য যথেষ্ট কাছাকাছি হতে হবে, তবে তাদের এত কাছাকাছি হওয়া উচিত নয় যে, তাদের জীবনক্ষম (viable) হিসেবে গণ্য করা হয়।
ক্যালটেকের (Caltech) জীববিজ্ঞান ও জৈবিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ম্যাগডালেনা জারনিকা-গোয়েজ (Magdalena Zernicka-Goetz) নতুন নির্দেশিকাগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর দল ইতিমধ্যে ভ্রূণ-সদৃশ মডেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা ১৪ দিনের ভ্রূণের মতো।
২০২৩ সালে, ইসরায়েলের উইজম্যান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের (Weizmann Institute of Science) অধ্যাপক ইয়াকব হান্না (Jacob Hanna) ত্বককোষ থেকে তৈরি একটি মডেল তৈরি করেছেন, যাতে ভ্রূণের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের কোষ ছিল।
এই গবেষণাগুলো গর্ভপাতের (miscarriage) কারণ অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, ১৪ দিনের মধ্যে মানব ভ্রূণ জরায়ুর (uterus) দেয়ালের সাথে যুক্ত হওয়া শুরু করে এবং অনেক গর্ভপাত এই সময়ে ঘটে থাকে।
এই ধরনের মডেলের মাধ্যমে, জীবিত মানব ভ্রূণের উপর করা সম্ভব নয় এমন গবেষণা করা যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)