যুদ্ধবিধ্বস্ত লাওসের এক গোপন ঘাঁটির গল্প: আমেরিকার শীতল যুদ্ধের অজানা অধ্যায়।
এক সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল লাওসের লং চিয়েন। দুর্গম জঙ্গলে ঘেরা এই জনপদ একসময় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (Central Intelligence Agency – CIA)-এর গোপন ঘাঁটি।
ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় কম্যুনিজমের বিস্তার রোধ করতে এখানে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল সামরিক কার্যক্রম।
লাওসের মধ্যাঞ্চলে, রাজধানী ভিয়েনতিয়েন থেকে প্রায় ৮০ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত লং চিয়েন গ্রাম। এখানকার ৪,৫০০ ফুটের একটি রানওয়ে একসময় ছিল সামরিক বিমানের আনাগোনায় মুখরিত।
কিন্তু এখন, কালের সাক্ষী হয়ে এটি পড়ে আছে নীরব, যেখানে শিশুরা খেলা করে, কৃষক গরু চরায়।
১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে, লং চিয়েন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গঠিত একটি গোপন সামরিক ঘাঁটির কেন্দ্র। এখানে বসবাস করত হাজার হাজার মানুষ – হমং সৈন্য, তাদের পরিবার, লাওসের অন্যান্য অঞ্চলের উদ্বাস্তু, থাই সৈন্য এবং কিছু সংখ্যক মার্কিন সিআইএ (CIA) এজেন্ট ও “রেভেনস” নামে পরিচিত মার্কিন বিমান বাহিনীর পাইলট।
এটি ছিল সিআইএ-র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বৃহত্তম আধা-সামরিক অভিযানগুলির একটি।
দীর্ঘদিন ধরে লং চিয়েনের রানওয়েটি দৈনিক প্রায় ৯০০ বার বিমান ওঠা-নামার সাক্ষী থেকেছে, যা এটিকে বিশ্বের ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলোর একটি করে তুলেছিল।
কার্গো বিমানগুলো এখানে অস্ত্রশস্ত্র এবং খাদ্য সরবরাহ করত, যা পরে ছোট বিমানে করে লাওসের বিভিন্ন গোপন ঘাঁটিতে পাঠানো হতো। এমনকি এই ঘাঁটির অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেক সৈন্যও অজ্ঞাত ছিল, যারা যুদ্ধের অন্য স্থানে মোতায়েন ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে কমিউনিস্ট প্যাথেট লাও বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য হমং সেনাবাহিনীকে সমর্থন জুগিয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ভাং পাও।
গোপন এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে, আমেরিকা ব্যাপক বোমা হামলা চালায়, যা সরাসরি ভিয়েতনামের সামরিক অভিযানের সমান্তরাল ছিল।
আন্তর্জাতিক চুক্তির কারণে, লাওসে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না, তাই এই কাজের পুরো দায়িত্ব ছিল সিআইএ-র ওপর।
এই গোপন যুদ্ধের স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে লং চিয়েন। যুদ্ধের সময় ফেলা হওয়া প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বোমা ও অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বিস্ফোরিত হয়নি।
ফলে এখানকার মানুষজন এখনও অবিস্ফোরিত অস্ত্রের আতঙ্কে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারে না।
লং চিয়েনের বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যায়। এক সময়ের সামরিক ছাউনিগুলো এখন কৃষকদের বাসস্থান, আর সামরিক বহরের পরিবর্তে এখানে চলে স্কুটার ও গরুর পাল।
এখানকার রাস্তাগুলো এখনও ভালোভাবে সংস্কার করা হয়নি, যা এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে।
বর্তমানে, লং চিয়েন ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সংখ্যা খুবই কম। এখানকার রাস্তাগুলো দুর্গম হওয়ার কারণে রাজধানী থেকে এখানে পৌঁছাতে আট ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।
তবে, যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো এখনও এখানে বিদ্যমান, যা এই অঞ্চলের মানুষের কষ্টগাঁথা তুলে ধরে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পরেও, লং চিয়েনের মানুষজন অতীতের সেই বিভীষিকা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পায়নি। এখানকার শিশুরা এখনও খেলার মাঠ হিসেবে রানওয়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানটিকেই বেছে নিতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে, লং চিয়েনে বিস্ফোরিত না হওয়া অস্ত্রের অপসারণের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। ১৯৯৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই কাজে প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৪,২৩০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করেছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন