দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত নাৎসি জার্মানির চলচ্চিত্র নির্মাতা লেনি রিফেনস্টালকে নিয়ে নির্মিত একটি নতুন প্রামাণ্যচিত্র বর্তমানে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ছবিটির নাম ‘রিফেনস্টাল’, যা পরিচালনা করেছেন আন্দ্রেস ভাইল।
এই ছবিতে রিফেনস্টালের গোপন জীবন এবং নাৎসিবাদের প্রতি তাঁর সমর্থন নতুন করে উন্মোচন করা হয়েছে। ছবিটিতে ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ, যা এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল।
লেনি রিফেনস্টাল ছিলেন একজন প্রতিভাবান চলচ্চিত্র পরিচালক। তাঁর নির্মিত ‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল’ (Triumph of the Will) এবং ‘অলিম্পিয়া’র (Olympia) মতো ছবিগুলো চলচ্চিত্র জগতে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
তবে এই ছবিগুলোর মাধ্যমে তিনি আসলে নাৎসিবাদের প্রচার করেছিলেন, যা যুদ্ধের ভয়াবহতাকে আড়াল করে নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি বরাবরই নিজেকে একজন নির্দোষ শিল্পী হিসেবে জাহির করেছেন, যিনি রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে কেবল শিল্পের চর্চা করেছেন।
তাঁর দাবি ছিল, তাঁর কাজগুলো ছিল নিছক শিল্পকর্ম, যার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু ‘রিফেনস্টাল’ প্রামাণ্যচিত্রে তাঁর এই দাবির অসারতা প্রমাণ করা হয়েছে। ছবিটিতে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পাওয়া বিভিন্ন নথি, যেমন চিঠি, ডায়েরি, এবং অডিও রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে জানা যায়, রিফেনস্টাল আসলে নাৎসি আদর্শের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন।
এমনকি যুদ্ধের সময় সংঘটিত বিভিন্ন নৃশংসতার বিষয়েও তিনি অবগত ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডে ইহুদিদের উপর চালানো এক গণহত্যার ঘটনার সময় তাঁর উপস্থিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
যদিও তিনি প্রথমে এই ঘটনাটি দেখেননি বলে দাবি করেছিলেন, পরে স্বীকার করেন যে তিনি সেখানে ছিলেন, তবে ঘটনার ভয়াবহতা দেখে তিনি ভীত হয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রে পাওয়া কিছু চিঠি থেকে জানা যায়, গণহত্যার পেছনে তাঁর পরোক্ষ ভূমিকা ছিল।
আন্দ্রেস ভাইলের এই ছবিতে রিফেনস্টালের শৈশব এবং বেড়ে ওঠার বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে। জানা যায়, রিফেনস্টাল শৈশবে কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন।
এই সময় তাঁর মধ্যে “শক্তি”, “কঠোরতা”, এবং “দুর্বলতার প্রতি ঘৃণা”-র মতো ধারণাগুলো গেঁথে যায়। ভাইলের মতে, এই বিষয়গুলোই হয়তো পরবর্তীতে নাৎসিবাদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ তৈরি করেছিল।
ছবিতে পরিচালক দেখিয়েছেন, কীভাবে রিফেনস্টাল তাঁর নির্মিত ছবিগুলোর মাধ্যমে নাৎসি জার্মানির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সহায়তা করেছেন। ‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল’ ছবিতে নাৎসি পার্টির বিশাল সমাবেশ এবং হিটলারের ক্ষমতা প্রদর্শনের দৃশ্যগুলো এমনভাবে ধারণ করা হয়েছে, যা দর্শকদের মধ্যে এক ধরনের মোহ তৈরি করে।
প্রামাণ্যচিত্রটি শুধু রিফেনস্টালের জীবনের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে না, বরং এটি ইতিহাসের সত্যকে বিকৃত করার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করে।
ছবিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে শক্তিশালী প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মনকে প্রভাবিত করা যায় এবং ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া যায়।
ছবিটির মাধ্যমে পরিচালক দর্শকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন রিফেনস্টালের শিল্পকর্মের সৌন্দর্য্যের মোহে না পরে, বরং তাঁর কাজের পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকে। কারণ, সৌন্দর্য্যের মোড়কে মোড়া এই ধরনের প্রচারণা ভয়ঙ্কর হতে পারে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান