আমদানি শুল্ক: কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ককে “ডিকশনারির সবচেয়ে সুন্দর শব্দ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি আবারও বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছেন। এই পদক্ষেপের কারণ হিসেবে জানা যায়, সরকার রাজস্ব বাড়াতে এবং দেশের উৎপাদন বাড়াতে চায়। কিন্তু এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা ঝাঁকুনি লাগতে পারে।
শুল্ক আসলে কী?
শুল্ক হলো একটি দেশের সীমান্ত দিয়ে আসা পণ্যের ওপর ধার্য করা কর। আমদানি করার সময় ব্যবসায়ীদের এই কর দিতে হয়। সাধারণত পণ্যের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে এই করের হার নির্ধারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো পণ্যের দাম যদি ১০০ টাকা হয়, আর তার ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়, তাহলে পণ্যটি দেশে প্রবেশ করার সময় ১০ টাকা শুল্ক দিতে হবে। শুধু তৈরি পণ্যই নয়, কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশ-এর ওপরও শুল্ক বসানো হয়। এর ফলে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়।
শুল্ক কিভাবে প্রভাব ফেলে?
শুল্ক আরোপের ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যায়, যা ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে গাড়ির দাম ৪,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর ফলে মানুষ শুল্কমুক্ত দেশি পণ্য কিনতে উৎসাহিত হতে পারে। এছাড়া, একটি দেশ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য শুল্ক ছাড়াও অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে পারে, যেমন – আমদানি কোটা, লাইসেন্স এবং পারমিট, নিরাপত্তা বিষয়ক নিয়মকানুন ইত্যাদি।
শুল্কের প্রভাব: একটি সম্ভাব্য বাণিজ্য যুদ্ধ?
একটি দেশ যখন শুল্ক আরোপ করে, তখন প্রায়ই অন্য দেশগুলোও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। এর ফলে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে পারে। শুল্ক সাধারণত দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার একটি অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এর প্রভাব শুধু অর্থনীতির ওপর নয়, আরও অনেক ক্ষেত্রে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল কি?
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। তারা ২০২৩ সালে প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। তাদের বাণিজ্য ঘাটতিও অনেক বেশি, যা ১ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদাররা “অন্যায্য” বাণিজ্য চর্চা করে। তিনি মনে করেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির দুর্বলতার লক্ষণ। তাই তিনি শুল্ককে দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান।
এর সম্ভাব্য প্রভাব কী?
শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়লে তা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। সবচেয়ে বড় ভয় হলো, বাণিজ্যে এই ধরনের বাধা বিশ্ব অর্থনীতির বৃদ্ধিতে খারাপ প্রভাব ফেলবে এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াবে। নতুন করে শুল্ক আরোপের আগেই এর হুমকি বিশ্ব বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। এর ফলে ব্যবসা এবং ভোক্তাদের মধ্যে আস্থা কমে যাচ্ছে। এছাড়া, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর ঋণ নেওয়ার খরচও বেড়ে গেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
শুল্ক কয়েক শতাব্দী ধরে বিশ্ব অর্থনীতির একটি অংশ। অতীতে এটি যুদ্ধ এবং বিপ্লবের কারণও হয়েছে। যেমন – ১৭৭৩ সালের বোস্টন টি পার্টি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বায়নের কারণে গত কয়েক দশকে শুল্কের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমেছে। ট্রাম্প এর আগেও প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন শুল্ক আরোপ করেছিলেন।
কোন দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এই শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশটির উৎপাদন ০.৭ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী কানাডা এবং মেক্সিকোও এর শিকার হবে। এছাড়া, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি (২৯৫ বিলিয়ন ডলার), এরপর রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (২৩৫ বিলিয়ন ডলার)।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ
ট্রাম্প চান, শুল্ক যেন “ন্যায্য ও পারস্পরিক” হয়। তিনি মনে করেন, কিছু দেশে শুল্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্য-সংক্রান্ত বাধা রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। এর মধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলোতে ব্যবহৃত মূল্য সংযোজন কর (Value Added Tax – VAT) অন্যতম। ট্রাম্পের মতে, এই করের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতাদের বেশি খরচ করতে হয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি পণ্যের ওপর এমন কোনো কর নেই। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভ্যাট স্থানীয় এবং আমদানি করা উভয় পণ্যের ওপরই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব
বিশ্ব বাণিজ্যে শুল্কের এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও কিছু প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে, পোশাক শিল্পের মতো রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লে, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান