গ্রহাণুতে প্রাণের ইঙ্গিত! বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কার

মহাকাশে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা? বিজ্ঞানীরা পেলেন সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ।

বহু দূর, প্রায় ১২৪ আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা জেগেছে। এই আবিষ্কারের ফলে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা যেমন আনন্দিত, তেমনই সতর্কও বটে।

যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিক্কু মধুসূদনের নেতৃত্বে গবেষকরা একটি গ্রহে, যা আমাদের সৌরজগতের বাইরে অবস্থিত, এমন দুটি রাসায়নিক পদার্থের সন্ধান পেয়েছেন, যা পৃথিবীতে সাধারণত জীবিত প্রাণীই তৈরি করে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি ভিনগ্রহের কোনো জগতে প্রাণের ইঙ্গিত দিতে পারে। এই আবিষ্কারের ফলে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, প্রাণের সম্ভাবনা আছে এমন গ্রহটি আসলে কোথায়? বিজ্ঞানীরা কী প্রমাণ পেয়েছেন? এবং এর কতটা নির্ভরযোগ্যতা রয়েছে?

গবেষকরা নাসা-র (NASA) জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope) থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করেছেন। এই টেলিস্কোপটি পৃথিবীর থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছে।

বিজ্ঞানীরা K2-18b নামক একটি গ্রহের উপর বিশেষভাবে নজর রেখেছিলেন, কারণ এর আগে এই গ্রহে পৃথিবীর মতো পরিবেশের কিছু সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল।

K2-18b গ্রহটি লিও নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থিত। এটি পৃথিবী থেকে এত দূরে যে, আলোর গতিতে কোনো মহাকাশযান গেলেও সেখানে পৌঁছতে ১২৪ বছর সময় লাগবে।

গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৮.৬ গুণ ভারী এবং ২.৬ গুণ বড়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি তার সূর্যের ‘গোল্ডিলকস জোনে’ (Goldilocks Zone) অবস্থান করছে।

এই অঞ্চলে কোনো গ্রহের তাপমাত্রা এমন হতে পারে যা তরল আকারে জলের অস্তিত্বের জন্য উপযুক্ত।

২০২৩ সালে, ক্যামব্রিজের বিজ্ঞানীরা এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে মিথেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের সন্ধান পান। এর আগে কোনো নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে অবস্থিত কোনো গ্রহে কার্বন-ভিত্তিক অণুর সন্ধান পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞানীদের মতে, প্রথমে মহাসাগর এবং পরে হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল থাকার কারণে এখানে কার্বন-ভিত্তিক অণুগুলির সৃষ্টি হতে পারে। সহজ কথায়, গ্রহটিতে জলের উপস্থিতি সম্ভব।

এবার বিজ্ঞানীরা আরও জোরালো প্রমাণ পেয়েছেন যা ইঙ্গিত করে যে, K2-18b গ্রহে শুধু জীবনধারণের উপযুক্ত পরিবেশই নেই, বরং সেখানে প্রাণের অস্তিত্বও থাকতে পারে।

দূরবর্তী গ্রহগুলি অধ্যয়নের জন্য বিজ্ঞানীরা সেগুলোকে সূর্যের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় পর্যবেক্ষণ করেন। সূর্যের আলো যখন এই গ্রহগুলির বায়ুমণ্ডল ভেদ করে যায়, তখন বিজ্ঞানীরা সেই আলোর বিশ্লেষণ করে থাকেন।

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গবেষক দল K2-18b গ্রহের বায়ুমণ্ডলে ডাইমিথাইল সালফাইড (DMS) অথবা ডাইমিথাইল ডিসালফাইড (DMDS) অথবা উভয় পদার্থের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। পৃথিবীতে, এই রাসায়নিক যৌগগুলি শুধুমাত্র জীবিত প্রাণী, বিশেষ করে সামুদ্রিক ফাইটোপ্লাঙ্কটন (phytoplankton)-এর মতো অণুজীব দ্বারা উৎপাদিত হয়।

বিজ্ঞানীরা আরও দেখেছেন যে, K2-18b-এর বায়ুমণ্ডলে এই রাসায়নিকগুলির ঘনত্ব পৃথিবীর তুলনায় কয়েক হাজার গুণ বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে অবস্থিত স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষক ম্যানস হোলবার্গ (Mans Holmberg) জানিয়েছেন, “পর্যবেক্ষণের ফলগুলি যখন একের পর এক আসতে শুরু করলো এবং তা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হলো, তখন এটি ছিল অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা।”

বিজ্ঞানীরা তাঁদের এই গবেষণা ‘Astrophysical Journal Letters’ নামক একটি জার্নালে প্রকাশ করেছেন। এই জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার অর্থ হলো, অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও তাঁদের গবেষণাপত্রটি পর্যালোচনা করে এর সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন।

তবে, এর মানে এই নয় যে বিজ্ঞানীরা প্রাণের চূড়ান্ত প্রমাণ পেয়ে গেছেন। মধুসূদন স্বীকার করেছেন যে, K2-18b-এর বায়ুমণ্ডলে পাওয়া DMS এবং DMDS-এর উৎস অন্য কোনো অজানা রাসায়নিক প্রক্রিয়াও হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, “আমাদের ফলাফল নিয়ে গভীর সন্দেহ রাখা জরুরি, কারণ আমরা বারবার পরীক্ষা করার পরেই নিশ্চিত হতে পারব।”

ক্যামব্রিজ ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমির (Institute of Astronomy) সদস্য সাভাস কনস্টান্টিনৌ (Savvas Constantinou) বলেছেন, “এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলি নিশ্চিত করতে এবং এর প্রভাব বুঝতে আমাদের আরও অনেক গবেষণা করতে হবে।”

কয়েক বছর আগেও মহাকাশে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার হয়েছিল। ২০১১ সালে, নাসার বিজ্ঞানীরা (NASA scientists) আন্টার্কটিকায় (Antarctica) পাওয়া কিছু উল্কাপিণ্ডের (meteorites) মধ্যে ডিএনএ-এর উপাদান খুঁজে পান।

২০১২ সালে, কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের (Copenhagen University) বিজ্ঞানীরা একটি দূরবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জে শর্করা জাতীয় অণুর সন্ধান পান, যা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

২০২৩ সালে, বিজ্ঞানীরা শনির উপগ্রহ এনসেলাডাসের (Enceladus) চারপাশে জৈব অণুর সন্ধান পান।

তবে, বিজ্ঞান সব সময় সরল পথে চলে না। ২০০৫ সালে, নাসার দুই বিজ্ঞানী দাবি করেছিলেন যে, তাঁরা মঙ্গলে (Mars) প্রাণের সম্ভাব্য চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন।

তবে, সেই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় টেকে নি এবং নাসা তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

ক্যামব্রিজ-এর গবেষক দল DMS এবং DMDS-এর উপস্থিতি ৯৯.৭ শতাংশ নিশ্চিত করেছেন। তবে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোনো নতুন আবিষ্কারকে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে হলে ৯৯.৯৯৯৯৪ শতাংশ নিশ্চিত হতে হয়।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের (James Webb Telescope) আরও বেশি ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁরা এই স্তরে পৌঁছতে পারবেন।

মধুসূদনের মতে, “হয়তো কয়েক দশক পর আমরা ফিরে তাকিয়ে দেখব যে, এই সময়েই মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান প্রায় হাতের নাগালে চলে এসেছিল। সম্ভবত, এটিই সেই মুহূর্ত যখন আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবো যে, আমরা কি সত্যিই মহাবিশ্বে একা?”

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *