ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মী মাহমুদ খলিলের মুক্তি নিয়ে আজ রায় দেবেন লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একজন অভিবাসন বিষয়ক বিচারক। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে আঘাত হানার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে কীভাবে ঘটনার সূত্রপাত হলো, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মী মাহমুদ খলিলকে বিতাড়িত করার জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আসছেন তাঁর আইনজীবীরা। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় দেওয়া একটি বিতাড়ন আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত এক মাস ধরে তিনি আটক রয়েছেন। সহকারী প্রধান অভিবাসন বিচারক জ্যামি কোম্যান্স বুধবারের মধ্যে সরকারের কাছে প্রমাণ চেয়েছেন, কেন খলিলকে বিতাড়ন করা হবে। অন্যথায় তিনি এই মামলাটি খারিজ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারকো রুবিও’র দেওয়া একটি স্মারকলিপিতে অভিযোগ করা হয়েছে, খলিল তাঁর “বিশ্বাস, বক্তব্য বা সংশ্লিষ্টতার” কারণে বিতাড়িত হওয়ার যোগ্য। কারণ, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থের পরিপন্থী। তবে, রুবিও’র স্বাক্ষর করা এই স্মারকলিপিতে কোনো ফৌজদারি অপরাধের উল্লেখ নেই।
খলিলের আইনজীবীরা আদালতে যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই মূলত তাঁকে নিশানা করা হচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে দেওয়া বাকস্বাধীনতার অধিকারের লঙ্ঘন। তাঁর আইনজীবী মার্ক ভ্যান ডার হাউট বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, “এই মামলার মূল বিষয় হলো, এই দেশে বসবাসকারী নাগরিক এবং অভিবাসী—সবারই সংবিধান এবং প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে।”
শুক্রবার শুনানিতে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে, খলিলকে বিতাড়িত করার যথেষ্ট কারণ তাদের কাছে আছে। আইনজীবীরা বলছেন, এই শুনানির ফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। অপর এক আইনজীবী জনি সিনোডিস বলেন, “সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে কাউকে বিতাড়িত করতে পারে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমাদের অবস্থান হলো, তারা তা করতে পারে না।”
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যাডাম কক্সের মতে, খলিলকে বিতাড়ন করা হবে কিনা, তা নির্ভর করবে সরকারের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে কিনা তার ওপর। যদি বিতাড়নের স্বপক্ষে প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। তবে, কক্স আরও বলেন, “যদি আদালত খলিলকে বিতাড়নের যোগ্য মনে করেন, এর মানে এই নয় যে, সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে বিতাড়িত করা হবে। বিতাড়নের যোগ্য ব্যক্তিরাও এর বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন।”
আদালতের শুনানির আগেই খলিলের আইনজীবীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে বিচারক দ্রুত রায় দিলে সরকারের অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়ার সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন। আইনজীবীরা শুনানিতে প্রমাণ খণ্ডন করার এবং রুবিওকে জেরা করার সুযোগ চেয়েছেন। ভ্যান ডার হাউট বলেন, “আমাদের অধিকার আছে, জনাব খলিলের অধিকার আছে—তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণ খতিয়ে দেখার।”
এই ঘটনার সূত্রপাত হয় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন। গত বছর গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সময় খলিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মার্চ মাসে খলিলকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবনের বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় তাঁর স্ত্রী, যিনি একজন মার্কিন নাগরিক এবং নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তাঁর সঙ্গেই থাকতেন। এরপর তাঁকে লুইজিয়ানার একটি ডিটেনশন সেন্টারে নেওয়া হয়, যেখানে তাঁর অভিবাসন বিষয়ক কার্যক্রম চলছে। খলিলের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে একটি পৃথক মামলা নিউ জার্সিতেও চলছে, যেখানে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খলিলের বিতাড়নের কারণ হলো, তিনি “যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করেছেন।” রুবিও’র স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, খলিলের “কর্মকাণ্ড এবং অব্যাহত উপস্থিতি” যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে দুর্বল করে, যা বিশ্বে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ইহুদি শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও সহিংসতার হাত থেকে রক্ষার প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
খলিলের আইনজীবীরা বলছেন, তাঁরা আশা করছেন না যে, সরকার এই অভিযোগের সমর্থনে কোনো অতিরিক্ত প্রমাণ জমা দেবে। ভ্যান ডার হাউটের মতে, সরকার খলিলের বিক্ষোভ-আলোচনায় অংশগ্রহণের প্রমাণ দেখালেও পররাষ্ট্রনীতি লঙ্ঘনের অভিযোগের সমর্থনে কোনো প্রমাণ জমা দেয়নি।
ভ্যান ডার হাউট আরও বলেন, “রুবিও’র চিঠিই এই মামলার প্রধান অভিযোগের একমাত্র প্রমাণ।” তিনি সরকারের ইহুদিবিদ্বেষের বর্ণনারও সমালোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা (ICE) দাবি করে, তাদের হেফাজতে নেওয়া ব্যক্তিরা শাস্তির শিকার নন। তবে, কিছু অভিবাসন আইনজীবী মনে করেন, ICE ইচ্ছাকৃতভাবে অভিযুক্তদের তাঁদের আইনজীবী, পরিবার এবং সমর্থন ব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
খলিলসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা, যারা বৈধভাবে বসবাস করছিলেন বা স্টুডেন্ট ভিসায় ছিলেন, তাঁদের অভিবাসনবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে আটক করা হয়েছে। এই বছর এরই মধ্যে ৪০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকের ভিসা বাতিল করা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন খলিলকে হামাস সমর্থক হিসেবে অভিযুক্ত করে জানায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইনের একটি ধারা ব্যবহার করছে, যা পররাষ্ট্রনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিতাড়নের ক্ষমতা দেয়।
আইন বিশেষজ্ঞ কক্সের মতে, এই ধারাটি খুবই অস্পষ্ট। তিনি আরও জানান, ১৯৯০ সালে এই ধারা তৈরি হওয়ার পর থেকে ১ কোটি ১৭ লাখ বিতাড়ন মামলার মধ্যে মাত্র ১৫টিতে এটি ব্যবহার করা হয়েছে।
অধ্যাপক কক্স মনে করেন, খলিলের মামলার রায় ভবিষ্যতে অনুরূপ মামলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন