যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি কিশোরী মালাকের গল্প।
গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকার হামামা বালিকা বিদ্যালয়ে পরিচয় হয়েছিল মালাক ও আমার। মালাকের পরিবার আমাদের বাড়ির কাছেই একটি অ্যাপার্টমেন্টে এসে থাকতে শুরু করে।
এরপর থেকেই, প্রতিদিন আমাদের একসাথে স্কুলে যাওয়া-আসা ছিল যেন এক স্বাভাবিক রুটিন। মালাক ছিল লাজুক, শান্ত ও খুবই স্নেহময়ী।
তার নাম ‘মালাক’-এর মতোই যেন এক দেবীর প্রতিচ্ছবি।
স্কুলের বন্ধুদের প্রতি তার ছিল গভীর মমতা। কারো মন খারাপ থাকলে, সে সবসময় তাদের পাশে এসে দাঁড়াত।
গণিত, পদার্থবিদ্যা আর সঙ্গীতের প্রতি আমাদের দুজনেরই ছিল প্রবল আগ্রহ। আমি পদার্থবিদ্যায় আগ্রহী ছিলাম, আর মালাক ভালো করতো গণিতে।
আমরা দুজনেই পিয়ানো বাজাতাম। আমি ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলাম, আর মালাকের ভালো লাগতো ফিলিস্তিনের লোকসংগীত।
একদিন, স্কুলের খেলার মাঠে বসে আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলছিলাম। মালাক জানায়, তার ছোট ভাই খালেদের জন্মগত হৃদরোগ রয়েছে।
সে হয়তো বেশি দিন বাঁচবে না। সে নার্স হতে চেয়েছিল, ফিলিস্তিনের পুরনো শহর রামলায় ফিরে যেতে চেয়েছিল, যেখানে তার পরিবার একসময় বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।
সেখানে গিয়ে সে অসুস্থ শিশুদের সেবা করতে চেয়েছিল। যুদ্ধের বিভীষিকা আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নেওয়ার আগে, মালাকের এমন স্বপ্ন ছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা সবাই আলাদা হয়ে যাই। গাজা শহরের বাড়িঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে আমরা বারবার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি।
কিন্তু আমি মালাকের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। তার ফোন বন্ধ ছিল। আমাদের স্কুলটিকেও উদ্বাস্তুদের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল, পরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় সেটি ধ্বংস হয়ে যায়।
দীর্ঘদিন পর, আমি যখন রাফায় আশ্রয় নিয়েছিলাম, তখন একদিন একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। ওপাশ থেকে মালাকের কণ্ঠ শুনে আমি যেন শান্তি পেলাম।
সে জানায়, তারা রাফার আল-মাওয়াসিতে একটি তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে। কথা বলতে গিয়ে সে আমাদের পুরনো দিনের কথাগুলো মনে করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো।
কথা শেষে, আমি তাকে আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালাম। কিন্তু এর দু’দিন পরেই, আমার কাছে আসে সেই হৃদয়বিদারক খবর।
মালাকের ছোট বোন ফারাহ জানায়, ভোরে তাদের তাঁবুতে একটি গুলি এসে লাগে, আর তাতেই মালাকের মৃত্যু হয়। আমার দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।
পরের দিন, আমি আর আমার মা মালাকের পরিবারের সাথে দেখা করতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, তাদের তাঁবুতে গুলির চিহ্ন।
খবর পেলাম, মালাকের মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার ভাই খালেদও মারা গেছে।
মালাককে কে হত্যা করলো? কেনই বা তাকে খুন করা হলো? ঘুমের মধ্যে থাকা মালাক কি সেনাদের জন্য কোনো হুমকি ছিল? নাকি, তারা ভয় পেয়েছিল রামলায় ফিরে আসার তার স্বপ্নকে?
বিদায় বন্ধু, মালাক। আমি তোকে ভুলব না কোনোদিন। তোর নামে একটি জলপাই গাছ লাগাবো, আর তোর পরিবারের যারা বেঁচে আছে, তাদের সবসময় আমাদের সাথে রাখবো, তাদের দেখাশোনা করবো যেমনটা তুই করতে চেয়েছিলিস।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা