মালি: রুশ ভাড়াটে সৈন্য ও সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলার অভিযোগ
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে রুশ ভাড়াটে সৈন্য এবং সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলির খবর অনুযায়ী, দেশটির উত্তরাঞ্চলে সম্প্রতি সাধারণ মানুষের উপর চালানো হয়েছে একাধিক সহিংসতা।
এর ফলস্বরূপ বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেকে।
ফেব্রুয়ারি মাসে গাও অঞ্চলের কাছে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন এমন একদল বেসামরিক নাগরিকের উপর হামলা হয়। হামলায় অন্তত কুড়ি জনের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধও ছিলেন।
অভিযোগ উঠেছে, মালির সেনাবাহিনী এবং রাশিয়ার ওয়াগনার গোষ্ঠীর ভাড়াটে সৈন্যরা এই হামলা চালিয়েছিল।
মালির সরকার ঘটনার তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিলেও, এখন পর্যন্ত কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলি এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তাদের মতে, মালির সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই বেসামরিক নাগরিকদের উপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে।
এখন তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে রুশ ভাড়াটে সৈন্যরা, যারা ফরাসি সৈন্যদের প্রস্থানের পর থেকে দেশটিতে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াগনার বাহিনী প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর থেকে তাদের তৎপরতা বেড়েছে।
বিশেষ করে আগস্ট মাস থেকে তারা বেসামরিক নাগরিকদের উপর সহিংসতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মালির সরকার আল-কায়েদা এবং আইএসআইএলের (ISIS) সঙ্গে যুক্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে দুর্বল করতে চাইছে।
তাদের সন্দেহ, উত্তরাঞ্চলের কিছু গ্রামবাসী এইসব গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল।
তবে, এখানকার তুয়ারেগ গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের লড়াই চলছে, যারা “আজাওয়াদ” নামে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য লড়ছে।
বর্তমানে মালির ফ্রন্ট লাইনে এক হাজার থেকে ১৫০০ জন রুশ ওয়াগনার সেনা সক্রিয় রয়েছে।
ওয়াগনার সেনারা মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং সুদানেও কাজ করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া এখন ওয়াগনার গোষ্ঠীকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
প্রিগোশিনের বিদ্রোহের পর তারা সম্ভবত ওয়াগনারের ক্ষমতা কমাতে চাইছে।
তবে, এটিকে একেবারে বন্ধ করে দিলে, রাশিয়ার পক্ষে সাহেল অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করা কঠিন হয়ে পড়বে।
বর্তমানে, ওয়াগনার বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইভান আলেকজান্দ্রোভিচ মাসলভ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সত্ত্বেও, তারা মালির সরকারকে তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে চাইছে।
২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে ওয়াগনারের কার্যকলাপ আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
রুশ সেনারা মালির দুর্গম উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে, যেখানে আলজেরিয়ার সীমান্ত কাছাকাছি অবস্থিত।
সেখানে কোনো বিমান সহায়তা বা চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া কঠিন।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মে থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে মালির সেনাবাহিনী এবং রুশ সেনারা “অন্তত ৩২ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে ৭ জন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে।
এছাড়াও, তারা আরও ৪ জনকে জোর করে গুম করেছে এবং অন্তত ১০০টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে”।
একই সময়ে, জেএনআইএম ও আইএসজিএস-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও বহু বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১২ সালে মালিতে সংকট শুরু হয়, যখন তুয়ারেগ বিদ্রোহীরা দেশটির উত্তরাঞ্চলের তিনটি শহর দখল করে নেয়।
এরপর তারা একটি স্বাধীন আজাওয়াদ রাষ্ট্র ঘোষণা করে।
মালির তৎকালীন সরকার ফরাসি ও জাতিসংঘের সাহায্য চেয়েছিল।
২০১৫ সালে বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে তাদের কিছু স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়।
তবে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির হামলা চলতেই থাকে।
বর্তমানে, মালির সেনাবাহিনী ওয়াগনারের সহায়তায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।
২০২৩ সালের শেষ দিকে, তারা কিদাল শহর পুনরুদ্ধার করে।
ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ, সরকার ইনাতাকা সোনার খনিও পুনরুদ্ধার করে, যা বিদ্রোহীদের দখলে ছিল।
এসব সাফল্যের ফলে বেসামরিক নাগরিকদের জীবনহানি বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কনস্টান্টিন গুভি বলেছেন, “ওয়াগনার যা করতে চায়, অন্য কেউ তা করতে চায় না।”
তিনি আরও যোগ করেন, সম্ভবত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া এই মুহূর্তে ওয়াগনার এবং আফ্রিকা কর্পস-এর মাধ্যমে সাহেল অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা