**বিশ্বের বিশাল ঢেউ জয় করে পরিবেশ রক্ষার যোদ্ধা: মায়া গাবেইরা**
নজরুলের ‘কুলি-মজুর’ কবিতার মতোই, মায়া গাবেইরা যেন এক অন্যরকম ‘সাগর-কন্যা’। ব্রাজিলের এই নারী শুধু বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করেই ক্ষান্ত হননি, বরং সমুদ্রকে বাঁচাতে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধেও লড়ে যাচ্ছেন।
**নজরতের দৈত্যাকার ঢেউ আর মায়ার লড়াই**
পর্তুগালের উপকূলীয় গ্রাম নাজারেতের সমুদ্র শান্ত থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। কিন্তু শীতকালে এখানকার সমুদ্রগর্ভের গিরিখাত দিয়ে বয়ে আসা ঝোড়ো হাওয়া বিশাল ঢেউ তৈরি করে, যা অনেকটা পর্বতের মতো।
এই কারণে নাজারেতকে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০১১ সাল থেকে বিশ্বের সেরা সার্ফাররা এখানে ভিড় করেন। তাদেরই একজন হলেন মায়া গাবেইরা।
রিও ডি জেনিরোতে বেড়ে ওঠা মায়ার ছোটবেলাটা ছিল কষ্টের। মারাত্মক অ্যাজমা ছিল তার, আর শ্বাসকষ্টের ভয়ে তিনি সবসময় ভীত থাকতেন। অনেকের কাছে হয়তো সমুদ্র এড়িয়ে চলাটাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু মায়ার ক্ষেত্রে ঘটল ঠিক উল্টোটা।
জীবনের অর্ধেক সময় তিনি কাটিয়েছেন সমুদ্রের কাছাকাছি। ২০১৩ সালে একবার বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি। এরপর ভেঙে যায় তার পা এবং মেরুদণ্ড।
কিন্তু এরপরই যেন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর পণ করেন মায়া।
দীর্ঘ চার বছর পর, ২০১৮ সালে তিনি ৬১ ফুট (প্রায় ১৮.৫ মিটার) উচ্চতার একটি ঢেউয়ে সার্ফিং করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। এরপর ২০২০ সালে সেই রেকর্ড ভেঙে তিনি ৭৩.৫ ফুট (প্রায় ২২ মিটার) উচ্চতার ঢেউয়ে সার্ফিং করেন। যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সার্ফিং ইতিহাসের অন্যতম সেরা ঘটনা।
**পরিবেশ রক্ষায় মায়ার সংগ্রাম**
সমুদ্রে কাটানো সময় মায়াকে শিখিয়েছে পরিবেশের প্রতি মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে। বিশেষ করে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার কথায়, “সমুদ্র যেন এখন আবর্জনার ভাগাড়।”
ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব শিখেছিলেন মায়া। তার বাবা ছিলেন ব্রাজিলের গ্রিন পার্টির সদস্য। বাবার সেই আদর্শকে সঙ্গে নিয়ে মায়া এখন পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন।
২০২১ সাল থেকে মায়া ‘ওশেনা’ নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন। এই সংস্থা সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ রোধে কাজ করে। এছাড়া, ব্রাজিলের একটি খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থাকে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে উৎসাহিত করতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
বর্তমানে তিনি জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়ন ফর দ্য ওশান অ্যান্ড ইয়ুথ’ হিসেবে তরুণদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন।
মায়ার মতে, একজন সার্ফার হিসেবে সমুদ্রের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। আর কোনো কিছুকে ভালোবাসলে, তাকে রক্ষা করতে ইচ্ছা করে। তাই সমুদ্রের প্রতি ভালোবাসার টানেই তিনি এই কাজগুলো করে যাচ্ছেন।
**বিদায় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা**
২০২৩ সালে মায়া গাবেইরা সার্ফিং থেকে অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নাজারেতেই থাকছেন এবং তার দুটি কুকুরকে নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন।
বাংলাদেশেও সমুদ্র এবং নদ-নদী দূষণের একটি বড় সমস্যা রয়েছে। মায়ার এই সংগ্রাম বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হতে পারে।
তার কাজের মাধ্যমে আমরা প্লাস্টিক দূষণ রোধ এবং পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে পারি।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক