শিরোনাম: ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে মেয়ের অনুপ্রেরণা, মায়ের স্মৃতি আজও অম্লান।
মৃত্যুকালে বয়স ছিল মাত্র সাতান্ন বছর। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে অবশেষে জীবন-যুদ্ধে হার মানেন ডেবোরা ফিঙ্ক।
তবে মৃত্যুর আগে তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর সাহস, জীবনবোধ আর অগণিত মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা। টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে তাঁর বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল আট লক্ষাধিক মানুষের কাছে।
নিজের অভিজ্ঞতা, পরিবার, ভালোবাসার গল্প, আর জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা—এসব নিয়েই তিনি ছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ।
২০২০ সালের মার্চ মাসে, ডেবোরার শরীরে ধরা পরেছিল বিরল এক প্রকার ক্যান্সার, নাম—লেইওমাইওসারকোমা।
এরপর কেটেছে কঠিন পাঁচটা বছর। এই সময়ে তাঁর পাশে ছিলেন স্বামী পল এবং তিনজোড়া যমজ সন্তান—আলেক্স ও আমান্ডা (২৯), ক্যাটিরিনা ও স্টিভেন (২৪), এবং ডেভিড ও ড্যানিয়েল (২৩)।
মায়ের জীবনের শেষ দিনগুলোতে, ডেবোরাকে অনলাইনে ভিডিও বানানোর জন্য উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তাঁরই মেয়ে, ক্যাটিরিনা।
মায়ের মৃত্যুর পর, ক্যাটিরিনা আজও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়। মায়ের স্মৃতিচারণ করে তৈরি করেন বিভিন্ন ভিডিও, যা আজও অনেকের কাছে প্রিয়।
এ বছর, মা দিবস ছিল ডেবোরা ফিঙ্কবিহীন প্রথম মা দিবস। কিন্তু মা-কে সবসময় অনুভব করেন তাঁর সন্তানেরা।
ক্যাটিরিনা জানান, তাঁরা তাঁদের মায়ের মতোই দিনটি উদযাপন করেছেন—ছয় ভাইবোন এবং বাবা একসঙ্গে ছিলেন।
মায়ের পছন্দের মতোই সময় কাটিয়েছেন তাঁরা। ক্যাটিরিনার ভাষায়, “মা আমাদের সঙ্গেই আছেন, কারণ আমরা তাঁর কথা বলি, তাঁর মতো করে সময় কাটাই, এবং এমন কিছু করি যা দেখলে তিনি গর্বিত হতেন।”
ক্যাটিরিনা তাঁর মায়ের কথা বলতে গিয়ে জানান, ডেবোরা ছিলেন মিশুক প্রকৃতির মানুষ। সবার সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারতেন।
এলিভেটরে দেখা হওয়া অচেনা মানুষদেরও তিনি বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে দ্বিধা করতেন না।
ক্যাটিরিনার মনে হত, মা যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর জীবনটা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারতেন, তাহলে খুব ভালো করতেন।
আর তাই, জীবনের শেষ সময়ে এসে যখন শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে, তখন টিকটক ভিডিও তৈরি করাটা তাঁর কাছে এক নতুন আশ্রয় হয়েছিল।
ক্যাটিরিনার কথায়, “ক্যান্সারের কারণে মা একসময় বাইরে যেতে, রান্না করতে—এমনকি তাঁর পছন্দের অনেক কিছুই করতে পারতেন না। ঘরের মধ্যে একা থাকতে থাকতে তিনি একঘেয়ে হয়ে পড়েছিলেন।
সেই সময়ে টিকটক ভিডিও তৈরি করাটা তাঁকে ব্যস্ত রেখেছিল, অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল।”
মা ও মেয়ের এই জুটি সবসময় একসঙ্গে ভালো কাজ করেছেন। ছোটবেলায় ক্যাটিরিনা যখন মডেলিং ও অভিনয়ে যুক্ত ছিলেন, তখন মা ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা।
মা-ই ছিলেন তাঁর ‘ম্যানেজার’। সবসময় মেয়ের পাশে থেকে তাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
ডেবোরা নিজেও অভিনয় ও মডেলিং করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মেয়ের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় খ্যাতি অর্জন যেন তাঁর সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়ারই নামান্তর।
ক্যাটিরিনা যখন তাঁর মাকে টিকটক ভিডিও তৈরি করতে উৎসাহিত করেন, তখন তিনি নিজে একজন ‘ডগ-মম’ ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁর প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার ফলোয়ার ছিল।
মায়ের জীবনযাত্রা দেখে, তাঁর মনে হয়েছিল, ডেবোরার কথাগুলো বহু মানুষের জীবনে অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে।
২০২০ সাল থেকে, ডেবোরার রোগ যখন ক্রমশ বাড়ছিল, তখনও তিনি হার মানতে রাজি ছিলেন না।
ফুসফুসে বাসা বাঁধা লেইওমাইওসারকোমা থেকে মুক্তি পেতে তিনি সবসময় চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রেখেছিলেন।
ক্যাটিরিনা জানান, তিনি সবসময় মাকে দেখতে যেতেন, যদিও তাঁরা দু’জন ভিন্ন রাজ্যে থাকতেন।
ডেবোরা সবসময় বলতেন, “কষ্ট পেও না, সবসময় খুশি থাকো, কারণ জীবনটা সত্যিই সুন্দর।”
টিকটকে ভিডিও বানাতে ডেবোরা ভালোবাসতেন, আর তাঁর ফলোয়ারদের সংখ্যাও সেকথাই প্রমাণ করে।
মা ও মেয়ের একসঙ্গে কাজ করাটা যেন ছিল এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা।
ক্যাটিরিনা বলেন, “বাড়িতে বা হাসপাতালে—যখনই সুযোগ পেতাম, মা বলতেন, ‘একটা টিকটক করি?’ আমরা হাসতাম, একে অপরের সঙ্গে কথা বলতাম, আর আমাদের বন্ধুদের মতো দর্শকদের সঙ্গেও কথা বলতাম।
সোশ্যাল মিডিয়া তো এমনই—যোগাযোগ তৈরি করা, বন্ধু বানানো।”
কয়েক মাসের মধ্যেই ডেবরার জনপ্রিয়তা বাড়ে, কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে।
নভেম্বরে, ডেবোরাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেই সময়, তাঁর সন্তানেরা মিলে মায়ের সঙ্গে কিছু বিশেষ মুহূর্ত কাটানোর পরিকল্পনা করেন।
তাঁরা মাকে কিছু প্রশ্ন করেন এবং তাঁর উত্তরগুলো রেকর্ড করেন। ডেবোরা তাঁর প্রিয় স্মৃতিগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
তাঁর উত্তরগুলো ছিল— “বিয়ে করলে তুমি আমাদের কী বলতে চাও?”, “তোমার নাতি-নাতনিদের তুমি কী বলতে চাও?”
হাসপাতালে থাকাকালীন, ডেবোরার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হতো।
ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, তাঁর বেশি দিন বাঁচার সম্ভাবনা নেই।
তাঁরা বলেছিলেন, এবার হয়তো ‘শেষ-পর্যায়ের যত্ন’-এর ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু ডেবোরা তখনও হাল ছাড়তে রাজি ছিলেন না।
তিনি বলেছিলেন, “আমি এটা করব না, আমি অন্য উপায় খুঁজে বের করব।”
৩১শে ডিসেম্বর, ২০২৪, ডেবোরা তাঁর বাড়িতে ‘শেষ-পর্যায়ের যত্ন’ শুরু করেন।
ক্যাটিরিনা জানান, তিনি মাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি।
বাবার ব্যবসার দেখাশোনার সুবিধার জন্য, তিনি তাঁর কাজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন।
মায়ের পাশে থেকে তাঁকে সাহায্য করাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
যখন সময় ফুরিয়ে আসছিল, ডেবোরা তেমন কিছুই করতে চাইতেন না, কিন্তু সারাদিন ঘুমিয়েও থাকতে চাইতেন না।
ক্যাটিরিনা জানান, তাঁরা জানতেন না আর কত দিন তাঁরা একসঙ্গে থাকতে পারবেন, তাই মা তাঁর ফলোয়ারদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে তাঁরা সেই মূল্যবান সময়টুকু কাটাবেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি পরামর্শ ছিল—ক্যাটিরিনার মায়ের সঙ্গে বিয়ের পোশাকের দোকানে যাওয়া।
যদিও ক্যাটিরিনার বিয়ে হয়নি, তবু মা ও মেয়ের এই বিশেষ মুহূর্ত কাটানোর জন্য একজন বন্ধু এগিয়ে এসেছিলেন।
অবশেষে, তাঁরা একটি ব্রাইডাল বুটিকে যান, যেখানে ক্যাটিরিনা বিভিন্ন পোশাক পরেছিলেন আর মা তাঁর মতামত জানিয়েছিলেন।
ক্যাটিরিনার কথায়, “ছোটবেলা থেকেই আমি মাকে বলতাম, আমার বিয়ের দিন আমি তাঁর বিয়ের পোশাক পরব।
সেদিন যখন সবাই চলে গেল, মা আমাকে বলেছিলেন, আমার একটা পোশাক খুব ভালো লেগেছে।
তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর বিয়ের পোশাক পরতে হবে না, এমনকি নতুন পোশাকটিও কেনার প্রয়োজন নেই।
আমি মাকে বলেছিলাম, আমি সেই পোশাকটাই নেব, আর আমার রিসেপশনে তাঁর পোশাক পরব।
মা রাজি হয়েছিলেন।”
দু’দিন পরেই ডেবোরার মৃত্যু হয়।
সকলে ক্যাটিরিনাকে বলেছিলেন, এখন আর পোশাকটা কেনার দরকার নেই।
বিয়ের সময় হয়তো তিনি আবার নতুন করে পোশাক পছন্দ করতে চাইবেন।
কিন্তু ক্যাটিরিনা জানান, তিনি সেই মুহূর্তটা কখনোই ভুলতে পারবেন না।
ক্যাটিরিনার সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের।
তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, শেষ সময়ে মা আমার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করতেন, সবকিছু বলতে পারতেন।
একবার, হাসপাতালে মা খুব ভয় পেয়েছিলেন।
আমি তাঁর ঘরে থাকতে পারছিলাম না, গেস্ট রুমে গিয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পর, হাসপাতাল থেকে ফোন করে আমাকে আসতে বলা হলো।
আমরা দু’জনে একসঙ্গে শুয়েছিলাম, মা এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যা আর কেউ জানে না।
আমরা হেসেছি, কেঁদেছি।
মা বলেছিলেন, আমি যেন ভয় না পাই।
মা কতটা ভীত ছিলেন, তা তিনি বুঝিয়েছিলেন।”
মা-ই তো আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
ক্যাটিরিনার কথায়, “আমি মাকে বলেছিলাম, ‘মা, তুমি আমার সেরা বন্ধু, তুমি শ্রেষ্ঠ মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমার খুব খারাপ লাগছে, তোমার সঙ্গে এটা হচ্ছে।”
ডেবোরার মৃত্যুর পর, তাঁর সমস্ত অনুরাগী এখন ক্যাটিরিনাকে অনুসরণ করেন।
ক্যাটিরিনা জানান, তিনি তাঁর মায়ের মতোই তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।
তিনি বিশ্বাস করেন, যদি ডেবোরার পাশে তাঁর অনলাইন সমর্থকরা না থাকতেন, যাঁরা তাঁকে সাহস জুগিয়েছিলেন, প্রার্থনা করেছিলেন, তাহলে হয়তো তিনি এত সহজে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারতেন না।
ক্যাটিরিনা আজও মায়ের স্মৃতি নিয়ে ভিডিও তৈরি করেন।
মায়ের পছন্দের সিনামন রোল তৈরির ভিডিও পোস্ট করেন, যা তাঁর মায়ের রান্নার স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।
ক্যাটিরিনা বলেন, “আমি টিকটকে আমার অনুভূতির কথা বলি, আর আমি জানি, মানুষ আমার মায়ের সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে চায়।
কিন্তু কিছু গল্প আছে, যা আমি নিজের কাছেই রাখতে চাই।
আমি প্রতিদিন হাসিখুশি থাকতে চাই, দিনের আলো দেখতে চাই।”
তাঁর মায়ের অনুরাগী, যাঁরা তাঁর ভালো থাকার দিনে খুশি হন।
ক্যাটিরিনা যখন আনন্দের মুহূর্তের ভিডিও শেয়ার করেন, তখন তাঁর অনুরাগী বলেন, “তোমার মায়ের আলো তোমার মধ্যে ঝলমল করে।
তুমিই তোমার মা, আর তিনি সবসময় তোমার সঙ্গে আছেন।”
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলে, ডেবোরার কথা মনে পড়ে ক্যাটিরিনার।
মায়ের সেই কথাগুলো আজও তাঁর কানে বাজে, “গুড মর্নিং, সানশাইন।”
তথ্য সূত্র: পিপল