মেনোপজ কি তবে অতীতের স্মৃতি? নতুন গবেষণায় আশায় বুক বাঁধছেন বিজ্ঞানীরা

শিরোনাম: মেনোপজ কি তবে অতীত? বিজ্ঞানীরা ঋতুস্রাব বন্ধের ধারণাকে নতুন পথে আনছেন।

নারীর জীবনে ঋতুস্রাব বন্ধ (মেনোপজ) একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সাধারণত চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে এটি শুরু হয় এবং এর সঙ্গে আসে শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তন।

কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান কি এই স্বাভাবিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে? বিজ্ঞানীরা এখন মেনোপজকে বিলম্বিত করার বা একেবারে বন্ধ করার সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন। এই গবেষণার ফলস্বরূপ নারীদের জীবনযাত্রায় আসতে পারে বড় ধরনের পরিবর্তন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক এবং প্রজনন জীববিজ্ঞানী ড. কুটলুক ওক্তায় মনে করেন, মেনোপজকে আর “নিয়তি” হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তার মতে, মানুষের শরীরে বার্ধক্যজনিত অন্যান্য পরিবর্তনের মতো মেনোপজকেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

মেনোপজ নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মতো হরমোনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। এর ফলে গরম লাগা (hot flashes), রাতে ঘাম হওয়া, যৌন মিলনে সমস্যা, হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস, এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।

হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এইচআরটি) কিছু ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো কমাতে সাহায্য করে, তবে হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস বা হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সবসময় সম্ভব হয় না।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা যদি মেনোপজের সময়সীমা পরিবর্তন করতে পারেন? গবেষণা চলছে এমন কিছু ওষুধের, যা মেনোপজের শুরুকে বিলম্বিত করতে পারে।

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ফার্টিলিটি সেন্টারের পরিচালক ড. জেভ উইলিয়ামস মনে করেন, মেনোপজকে “পরিবর্তনযোগ্য স্বাস্থ্য বিষয়ক ঘটনা” হিসেবে দেখা উচিত, একে “অনিবার্য” হিসেবে নয়।

ড. ওক্তায় এবং ড. উইলিয়ামস-এর দল ছাড়াও, আরও অনেক বিজ্ঞানী এই বিষয়ে কাজ করছেন।

ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক বায়োটেক কোম্পানি গ্যামেটো (Gameto) স্টেম সেল থেকে তৈরি ডিম্বাশয়ের কোষ ব্যবহার করে মেনোপজকে ধীর গতির করার চেষ্টা করছে।

এছাড়া, সেলম্যাটিক্স (Celmatix) নামে একটি সংস্থা এমন ওষুধ তৈরি করছে যা ডিম্বাশয়ের কর্মক্ষমতা হ্রাসের প্রক্রিয়াকে ধীর করবে।

কিছু গবেষক সেনোলাইটিক্স (senolytics) নামে পরিচিত ওষুধ নিয়ে কাজ করছেন, যা ক্ষতিগ্রস্ত কোষ সরিয়ে প্রদাহ ও রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।

আরও কিছু গবেষণা চলছে যা কোষের শক্তি বাড়াতে এবং স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে ডিম্বাশয়ের টিস্যু পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করবে।

যদিও এই গবেষণাগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।

ড. উইলিয়ামস মনে করেন, বিজ্ঞানীদের এই নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন মেনোপজকে বিলম্বিত করা সহজ হবে। এর ফলে বার্ধক্য প্রক্রিয়া এবং সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য সম্পর্কে নতুন ধারণা তৈরি হবে।

মেনোপজের কারণ এবং একে বিলম্বিত করার উপকারিতা।

মেনোপজ কেন হয়, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। তবে ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার কারণে এটি ঘটে, এমনটা ধারণা করা হয়।

মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সাথে সাথে মেনোপজের প্রভাব আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে।

ডিম্বাশয়ের বার্ধক্যকে বিলম্বিত করার মূল চাবিকাঠি হলো মেনোপজকে নিয়ন্ত্রণ করা।

সাধারণত, ৩৫ বছর বয়সের পর থেকেই ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে শুরু করে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মেনোপজকে বিলম্বিত করতে পারলে নারীদের প্রজনন ক্ষমতা এবং হরমোনের উৎপাদনকাল দুটোই বাড়ানো যেতে পারে।

এর ফলে মেনোপজের সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলোও কমানো সম্ভব হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, দেরিতে মেনোপজ শুরু হওয়া নারীদের হাড়ক্ষয়, হৃদরোগ এবং স্মৃতিভ্রংশতার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম থাকে।

ডা. ওক্তায় আরও মনে করেন, মেনোপজ বিলম্বিত করতে পারলে ডায়াবেটিস ও বিষণ্ণতার ঝুঁকিও কমানো যেতে পারে।

সেই সঙ্গে ত্বক, চুল ও দাঁতের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে, যা নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে।

বর্তমানে ড. ওক্তায় একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন।

এই পদ্ধতিতে, ডিম্বাশয়ের বাইরের স্তর (কর্টেক্স), যেখানে ডিম্বাণু জমা থাকে, তা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করে জমা করে রাখা হয়।

পরে, যখন মেনোপজের লক্ষণ দেখা যায়, তখন সেই টিস্যু আবার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।

তিনি মনে করেন, এই পদ্ধতির মাধ্যমে মেনোপজকে বিলম্বিত করা বা বন্ধ করা যেতে পারে।

ড. উইলিয়ামস এবং তার দল র‍্যাপামাইসিন (rapamycin) নামক একটি ওষুধ নিয়ে গবেষণা করছেন।

এটি মূলত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।

তারা ধারণা করছেন, র‍্যাপামাইসিনের কম ডোজ ব্যবহার করে ডিম্বাশয়ের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করা যেতে পারে।

যদি এই গবেষণা সফল হয়, তবে মেনোপজকে বিলম্বিত করার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

তবে, মেনোপজ বিলম্বিত করার ফলে ভবিষ্যতে কোনো ঝুঁকি আছে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

মেনোপজ নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেনের উৎপাদনকাল বাড়ায়, যা স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি সামান্য বাড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেনোপজকে বিলম্বিত করার চেয়ে বর্তমানে আইভিএফ (IVF) এবং এইচআরটি (HRT)-র মতো চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো বেশি পরীক্ষিত এবং নির্ভরযোগ্য।

এই গবেষণাগুলো নারীদের শরীর এবং তাদের প্রজনন ক্ষমতা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে উৎসাহিত করছে।

মেনোপজকে বিলম্বিত করার ফলে নারীরা হয়তো আরও বেশি সময় ধরে সন্তান ধারণ করতে পারবেন।

তবে এর কিছু নৈতিক এবং সামাজিক দিকও রয়েছে।

যেমন, বেশি বয়সে সন্তান ধারণ করা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যে ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ড. উইলিয়ামস মনে করেন, এই গবেষণা ডিম্বাশয়ের বার্ধক্যকে সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করে নতুনভাবে দেখার সুযোগ তৈরি করবে।

তবে, মেনোপজকে বিলম্বিত করার বিষয়টি সবার জন্য আকর্ষণীয় নাও হতে পারে।

মেনোপজের মূল সুবিধা হলো মাসিক ঋতুস্রাবের অবসান এবং অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের ঝুঁকি থেকে মুক্তি।

এই গবেষণাগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

তাই, মেনোপজকে জয় করার এই লড়াইয়ে বিজ্ঞানীদের জয় আসে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *