হারিয়ে যাওয়া কিংবদন্তি! বইয়ের ভাঁজে মিলল ম্যার্লিন ও কিং আর্থারের গোপন গল্প

মধ্যযুগের এক বিরল পুঁথি, যেখানে রাজা আর্থার ও জাদুকর মার্লিনের গল্প লিপিবদ্ধ ছিল, সেটি সম্প্রতি পাওয়া গেছে।

ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, এই অমূল্য পাণ্ডুলিপিটি আসলে অন্য একটি বইয়ের মলাটের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

গবেষকদের মতে, এটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘স্যুইট ভালগেট ডু মার্লিন’ নামক একটি গ্রন্থের অংশ।

মধ্যযুগের একজন লেখক পুরাতন ফরাসি ভাষায় হাতে লিখেছিলেন এই পাণ্ডুলিপিটি, যা কিং আর্থারের কিংবদন্তীর পরবর্তী ঘটনা নিয়ে লেখা।

জানা যায়, এই ধরনের পুঁথি বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটা রয়েছে।

আর্থারের এই কাহিনী, যা ‘ল্যান্সলট-গ্রেইল’ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত, একসময় অভিজাত ও রাজপরিবারের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহ বিষয়ক ফরাসি বিশেষজ্ঞ ড. আইরিন ফ্যাব্রি-তেহরানচি জানান, সে সময় এই গল্পগুলো হয় পাঠ করা হতো, নয়তো ট্রুভেয়ার নামক একদল কবি-গায়কের দল এক রাজসভা থেকে অন্য রাজসভায় গিয়ে পরিবেশন করতেন।

পুঁথিটির পাতাগুলো এতটাই পুরনো ও ভঙ্গুর ছিল যে, সেগুলোকে খুলে পাঠোদ্ধার করার ঝুঁকি ছিল।

তাই গবেষকরা বিশেষ ইমেজিং ও সিটি স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে এর একটি ত্রিমাত্রিক চিত্র তৈরি করেন।

এর ফলে পাতাগুলোকে না খুলেই এর ভেতরের লেখাগুলো পড়া সম্ভব হয়েছে।

ড. ফ্যাব্রি-তেহরানচি এই পাণ্ডুলিপির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সবার আগে।

তাঁর মতে, এমন আবিষ্কার “জীবনে একবারই” হয়।

স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে বই বাঁধানোর পুরনো কৌশল ও এর ভেতরের লুকানো অনেক তথ্যও জানা গেছে।

এই আবিষ্কার থেকে ১৬ শতকের ইংল্যান্ডের সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।

২০১৯ সালে কেমব্রিজের প্রাক্তন আর্কাইভিস্ট, সিয়ান কলিন্স, প্রথম এই পাণ্ডুলিপিটি খুঁজে পান।

এটি আসলে ছিল সাফোকে অবস্থিত ভ্যানেক পরিবারের হান্টিংফিল্ড ম্যানরের কিছু পুরনো নথির মলাট।

প্রথমে এটিকে ১৪ শতকের ‘স্যার গাওয়াইন’-এর গল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

কিন্তু কলিন্স লক্ষ করেন যে, লেখাটি পুরাতন ফরাসি ভাষায় লেখা, যা ১০৬৬ সালে নরম্যান বিজয়ের পর ইংল্যান্ডের অভিজাত ও রাজদরবারে ব্যবহৃত হত।

এছাড়াও, তিনি গল্পের মধ্যে ‘গাওয়াইন’ ও ‘এক্সক্যালিবুর’-এর মতো নাম খুঁজে পান।

গবেষকরা পাঠোদ্ধার করে জানতে পারেন যে, এখানে গাওয়াইন, তাঁর ভাই ও তাঁর পিতা রাজা লথের সঙ্গে স্যাক্সন রাজা ডোডালিস, মইদাস, ওরিয়ান্সেস ও ব্র্যান্ডালুসের যুদ্ধ এবং বিজয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

অন্য একটি পাতায় রাজা আর্থারের দরবারের একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে মার্লিনকে একজন সুদর্শন বাদ্যকারের ছদ্মবেশে দেখা যায়।

গবেষকদের অনুবাদ অনুযায়ী, দৃশ্যটি ছিল এরকম:

“যখন তাঁরা ভোজ উপভোগ করছিলেন, সেই সময়ে কায়ের নামক এক ব্যক্তি রাজা আর্থার ও কুইন গুইনিভারের কাছে প্রথম থালাটি নিয়ে এলেন।

ঠিক তখনই খ্রিস্টান বিশ্বে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হলেন।

তিনি রেশমের পোশাক পরেছিলেন, যা সোনার সুতো ও মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি ছিল এবং তা পুরো ঘর আলোকিত করছিল।

এই দৃশ্যগুলো ‘স্যুইট ভালগেট ডু মার্লিন’-এর অংশ, যা সম্ভবত ১২৩০ সালে লেখা হয়েছিল।

এটি মার্লিন ও কিং আর্থারের জন্মকথা এবং আর্থারের রাজ্যাভিষেকের গল্প দিয়ে শুরু হয়।

ড. ফ্যাব্রি-তেহরানচি জানান, এই অংশে আর্থারের শাসনকালের প্রথম দিকের কথা বলা হয়েছে, যেখানে তিনি ব্রিটিশ ব্যারনদের বিদ্রোহ ও স্যাক্সনদের আক্রমণের সম্মুখীন হন।

মার্লিন সবসময় আর্থারকে সাহায্য করতেন, কৌশলগত পরামর্শ দিতেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও সাহায্য করতেন।

জানা গেছে, পঞ্চদশ শতকে মুদ্রণ শিল্পের প্রসার ঘটলে পুরাতন পুঁথিগুলোকে বইয়ের মলাট হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ে।

কারণ, সে সময় পুরাতন ফরাসি ভাষার পাঠোদ্ধার কঠিন হয়ে পড়েছিল এবং আর্থারের গল্প নিয়ে আধুনিক সংস্করণগুলো বাজারে আসায় পাঠকের চাহিদাও বদলে যায়।

ইতিহাসবিদ এবং ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. লরা ক্যাম্পবেল জানিয়েছেন, ১৩ শতকের ফরাসি ভাষার এই গল্পগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণ হারাতে শুরু করেছিল, তাই মুদ্রিত সংস্করণগুলি জনপ্রিয়তা পায়।

তাঁর মতে, আর্থারের কিংবদন্তীর এই ধারাবাহিক সাফল্যের কারণ হল, এটি একটি চিরন্তন গল্প, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের রুচি অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে।

গবেষকরা অতিবেগুনি ও ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে পাণ্ডুলিপিটির ছবি তোলেন, যা পাঠোদ্ধারে সাহায্য করেছে।

এছাড়াও, সিটি স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে এর ভেতরের স্তরগুলো পরীক্ষা করে একটি ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করা হয়েছে।

গবেষক দলের ধারণা, এই পদ্ধতিতে অন্যান্য পুরনো ও ভঙ্গুর পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়েও গবেষণা করা যেতে পারে।

তাঁদের এই পদ্ধতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *