মাটির বুকে জীবন: মেক্সিকোর শিল্পীদের হাতে প্রাণের গাছ!

মেক্সিকোর এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কারিগরদের হাতে মাটির রূপ নেয় জীবনবৃক্ষ। যুগ যুগ ধরে এই শিল্পকর্ম তাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে, যা বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছে।

রাজধানী মেক্সিকো সিটি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত মেটেপেক শহরে এই শিল্পকলার চর্চা আজও সমানতালে চলছে। এখানকার কারিগররা বংশ পরম্পরায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

তাদের তৈরি করা দৃষ্টিনন্দন ‘জীবনবৃক্ষ’ শুধু মেক্সিকোর নয়, বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে এক বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।

‘জীবনবৃক্ষ’ আসলে এক ধরনের সিরামিকের মূর্তি, যা বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের বিভিন্ন দৃশ্য এবং মেক্সিকোর লোককথার নানা চরিত্র ফুটিয়ে তোলে। এই বৃক্ষের কেন্দ্রে থাকে আদম ও ইভের মূর্তি।

তাদের দুপাশে সাপের প্রতিকৃতি দেখা যায়, যা ভালো ও মন্দের ধারণা দেয়। এছাড়াও, এই শিল্পকর্মে ক্যাটরিনা (মেক্সিকোর ডে অফ দ্য ডেড উৎসবের প্রতীক), এবং প্রাচীন নাহুয়া জাতির পবিত্র কুকুর ‘শলোইৎসকুয়িন্টলি’-র মতো বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করা হয়।

মেটেপেক শহরের মাটি জাদুঘরে প্রতি বছর এই ধরনের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়, যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কারিগররা তাদের তৈরি করা ‘জীবনবৃক্ষ’ জমা দেন। এই জাদুঘরটি বর্তমানে তিনশোর বেশি শিল্পকর্মের সংগ্রহশালা।

এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হিলারিও হার্নান্দেজ নামের এক কারিগর। তিনি জানান, তার পরিবারের সদস্যরা পাঁচ প্রজন্ম ধরে এই কাজ করে আসছেন।

হিলারির দাদা এখনো মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করেন, যা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। হিলারির ভাই ফেলিপে জানান, তাদের এই জ্ঞান মৌখিকভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।

হিলারির অন্য ভাই লুইস, যিনি ১২ বছর বয়স থেকে এই কাজ করছেন, বলেন, “ছোটবেলায় খেলাচ্ছলে যে কাজ শুরু করেছিলাম, সেটাই এখন আমার পেশা।

আরেকজন শিল্পী সেসিলিও সানচেজও তার বাবার কাছ থেকে এই শিল্প শিখেছেন এবং এখন তার স্ত্রী, সন্তান ও অন্যান্য আত্মীয়দের নিয়ে একটি কর্মশালা চালান।

সেসিলিও জানান, তারা তাদের শিল্পকর্মে মাটির নিজস্ব রং ব্যবহার করেন, যা এই শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

হিলারির তৈরি করা একটি বিশেষ ‘জীবনবৃক্ষ’-এর গল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি একবার পোপ ষষ্ঠদশ বেনেডিক্টের জন্য একটি বিশাল আকারের (প্রায় ৬.৬ ফুট লম্বা) মূর্তি তৈরি করেছিলেন।

এই কাজটি ছিল তার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। মূর্তিটি তৈরি করার পর, তিনি এটিকে ভেঙে যাওয়া থেকে বাঁচাতে প্রায় ২০০ রোল টয়লেট পেপার দিয়ে মুড়িয়েছিলেন।

পরবর্তীতে, ২০১৬ সালে তিনি পোপ ফ্রান্সিসের জন্য আরেকটি ‘জীবনবৃক্ষ’ তৈরি করেন। এই কাজটি ছিল আগের চেয়ে কিছুটা ছোট, তবে এর নকশা ছিল পোপের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে।

হিলারিও জানান, পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাক্ষাতকালে তিনি জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পান এবং এই শিল্পকর্মে তার আত্মনিয়োগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। হিলারির মতে, ‘জীবনবৃক্ষ’ তৈরি করা শুধু তাদের জীবিকার পথ নয়, বরং তাদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

মেক্সিকোর এই কারিগরদের জীবনযাত্রা এবং তাদের শিল্পের প্রতি উৎসর্গীকৃত মনোভাব বাংলাদেশের অনেক কারুশিল্পীর কথা মনে করিয়ে দেয়।

আমাদের দেশেও যুগ যুগ ধরে বাঁশ ও বেতের কাজ, মাটির তৈরি শিল্পকর্ম, জামদানি বুনন, এমনকি নকশিকাঁথার মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলো বংশ পরম্পরায় চলে আসছে।

এই ধরনের শিল্পকর্মগুলো শুধু আমাদের সংস্কৃতিকেই ধারণ করে না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *