মেক্সিকোতে মাদক চক্রের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও শূকরের ব্যবহার।
মেক্সিকোতে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলোর সহিংসতা দেশটির জন্য এক গভীর ক্ষত হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক দশকে, এই সহিংসতার কারণে হাজার হাজার মানুষ হারিয়ে গেছে। তাদের সন্ধানে সেখানকার বিজ্ঞানীরা এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করছেন, যেখানে উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম এবং শূকর ব্যবহার করা হচ্ছে। তাঁদের এই প্রচেষ্টা হয়তো অনেকMissing person-দের পরিবারের জন্য কিছুটা হলেও আশা যোগাতে পারে।
মেক্সিকোর অনুসন্ধানী দল, স্যাটেলাইট চিত্র, ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র এবং জৈবিক বিশ্লেষণের মতো অত্যাধুনিক কৌশল ব্যবহার করছে। এছাড়াও, মৃত শূকরদের শরীরে কাপড় পরিয়ে, তাদের বিভিন্ন উপায়ে—যেমন, প্যাক করার টেপ দিয়ে মোড়ানো, টুকরো করা, প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে রাখা, চুন দিয়ে ঢেকে দেওয়া অথবা পুড়িয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো করা হচ্ছে। এরপর তারা সেগুলোর ওপর নজর রাখছেন।
শূকরদের এই পরীক্ষার মূল কারণ হলো, তাদের ডিএনএ’র গঠন মানুষের খুব কাছাকাছি। বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের শরীরের আকার, চর্বি বিতরণ এবং ত্বকের গঠন—এসব ক্ষেত্রে শূকর ও মানুষের মধ্যে মিল রয়েছে। তাই মাদক চক্রের শিকার ব্যক্তিদের মৃতদেহ খুঁজে বের করার গবেষণায় শূকর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
২০০৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফেলিপে ক্যালডেরনের মাদক বিরোধী যুদ্ধের ঘোষণার পর থেকে মেক্সিকোতে নিখোঁজ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। অপরাধীদের মধ্যে নিজেদের অঞ্চল বিস্তারের লড়াইয়ে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় অনেককে গুম করা হতো, যা ছিল এক প্রকারের কৌশল। কর্তৃপক্ষের নীরবতা বা অক্ষমতার কারণে অপরাধীরা প্রায়ই পার পেয়ে যেত।
মেক্সিকোতে নিখোঁজ হওয়া মানুষের সংখ্যা এতটাই বেশি যে, এটিকে একটি ছোট শহরের জনসংখ্যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ২০১৩ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নিখোঁজ হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ২৬,০০০। বর্তমানে সেই সংখ্যা ১,৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মতে, এই গুমের ঘটনাগুলো সম্ভবত “ব্যাপক বা পদ্ধতিগত”।
নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের জীবিত বা মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো পরিবারের সদস্যদের চেষ্টা। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে, তাঁরা নিজেরাই কার্টেল এলাকার ভেতরে প্রবেশ করে, ধাতব দণ্ড দিয়ে মাটি খুঁড়ে অথবা মৃত্যুর গন্ধ শুঁকে প্রিয়জনদের সন্ধান করেন। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬,০০০টি গোপন কবর আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এখনো নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। তবে, এখনো অনেক মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি।
এই অনুসন্ধানের জন্য গবেষকরা বিভিন্ন উদ্ভাবনী কৌশল ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে রয়েছে, বিশেষ ক্যামেরা লাগানো ড্রোন ব্যবহার করা, যা মাটির নিচে থাকা বিভিন্ন পদার্থের প্রতিফলন পরিমাপ করে। এছাড়া, থার্মাল ড্রোন, লেজার স্ক্যানার ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির নিচের পরিবর্তন ও বৈদ্যুতিক প্রবাহ শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি, শূকরদের পচন প্রক্রিয়া সরাসরি পর্যবেক্ষণের জন্য স্বচ্ছ কাঁচের বাক্সে তাদের সমাধিস্থ করা হচ্ছে।
গবেষকরা মৃতদেহ শনাক্ত করতে ফ্লাই, বিটল ও বিভিন্ন উদ্ভিদের নমুনা বিশ্লেষণ করছেন। প্রতিটি কবর একটি জীবন্ত “micro ecosystem”-এর মতো কাজ করে।
এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা স্যাটেলাইট বিশ্লেষণ, গ্রাউন্ড-পেনিট্রেটিং রাডার এবং বৈদ্যুতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষার মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এছাড়াও, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে মানুষের দেহাবশেষ পুঁতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। তাঁরা বলছেন, প্রযুক্তি তখনই কাজে আসে, যখন তা সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।
এই গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও যুক্ত আছেন। তাঁরা জানান, অনেক সময় গাছের শিকড়ের কারণে কবরগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে, মাটির গঠন ও উদ্ভিদের বিন্যাস দেখে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে কবর চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
তবে, প্রযুক্তি সবসময় সমাধান দিতে পারে না। অনুসন্ধানী দলের সদস্যরা মনে করেন, ভালো সাক্ষী এবং মাটি খোঁড়া—এগুলো এখনো অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
এই গবেষণার ফলাফল এখনো আসেনি। তবে, এরই মধ্যে জ্যালিসকো অনুসন্ধান কমিশন কিছু ক্ষেত্রে নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে বের করতে থার্মাল ড্রোন, লেজার স্ক্যানার ও মাল্টিস্পেকট্রাল ক্যামেরা ব্যবহার করছে। তবে, মেক্সিকোর সব অঞ্চলের কর্তৃপক্ষের পক্ষে এই উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার করা সম্ভব হবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস