ভারতে হুসেনের শিল্পকর্ম নিয়ে বিতর্ক: কেন এত আলোচনা?

ভারতে ‘পিকাসো অফ ইন্ডিয়া’ খ্যাত শিল্পী এম এফ হুসেন: শিল্পকর্মের রেকর্ড এবং হিন্দু রক্ষণশীলদের রোষানল।

বিখ্যাত ভারতীয় চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, যিনি ‘ভারতের পিকাসো’ নামে পরিচিত, তাঁর জীবন ও কর্ম আজও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর শিল্পকর্ম একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, তেমনই হিন্দুত্ববাদীদের তীব্র সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে।

সম্প্রতি তাঁর চিত্রকর্মের নিলাম ঘিরে ওঠা বিতর্ক আবারও সেই পুরোনো আলোচনাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

গত মার্চ মাসে, হুসেনের আঁকা একটি বিশাল চিত্রকর্ম ‘আনটাইটেলড (গ্রাম যাত্রা)’ নিউইয়র্কের ক্রিস্টি’স নিলামে ১৩.৭৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়, যা ভারতীয় আধুনিক শিল্পকলার ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড।

খবরটি শিল্পী ও শিল্পানুরাগীদের জন্য আনন্দের হলেও, এর কয়েক মাস পরেই মুম্বাইয়ে তাঁর আঁকা কিছু ছবির নিলামকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো হুসেনের ছবিতে দেবী-মূর্তির ‘অশ্লীল’ উপস্থাপনার অভিযোগ তুলে নিলাম বন্ধের দাবি জানায়।

যদিও পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সেই নিলাম অনুষ্ঠিত হয়, যা হুসেনের শিল্পকর্ম নিয়ে বিতর্কের আরেকটি দিক তুলে ধরে।

হুসেনের কাজের মূল্যায়ন আজও বিতর্কের বিষয়।

তাঁর কিছু চিত্রকর্ম একদিকে যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনই হিন্দু দেব-দেবীর নগ্ন চিত্র আঁকার কারণে তিনি সমালোচিতও হয়েছেন।

তাঁর ছবিতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠত, যা তাঁকে অনেকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

তিনি মা character Teresa থেকে শুরু করে বলিউড তারকা এবং পৌরাণিক চরিত্র—সবার ছবি এঁকেছেন।

কিন্তু তাঁর আঁকা কিছু ছবিতে হিন্দু দেব-দেবীর নগ্ন রূপের উপস্থাপনা রক্ষণশীল মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

অনেকে মনে করেন, এর পেছনে তাঁর মুসলিম পরিচয়ও একটি কারণ ছিল।

হুসেনের জীবন ছিল ঘটনাবহুল।

তাঁর কাজের জন্য তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, দীর্ঘকাল প্রবাসে কাটাতে হয়েছে এবং মৃত্যুর পরে তাঁর মরদেহও বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।

তাঁর প্রয়াণের এত বছর পরেও, তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক—এসবই শিল্পী হিসেবে তাঁর সম্মানে যেন এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।

হুসেন ১৯১৫ সালে মহারাষ্ট্রের পান্ধারপুরে জন্মগ্রহন করেন।

তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মধ্যে।

তিনি উর্দু ও ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি শিখেছেন, আবার স্থানীয় লোকনৃত্য ও রামায়ণের মতো হিন্দু ঐতিহ্যও তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

পরবর্তীকালে, তিনি মুম্বাইয়ে এসে সিনেমার বিলবোর্ড আঁকার কাজ শুরু করেন।

সেই সময়ে চলচ্চিত্রের জগৎ এবং সেখানকার রঙিন জীবনযাত্রা তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে।

দেশভাগের পর, হুসেন বোম্বে প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রুপ (Bombay Progressive Artists’ Group)-এর সঙ্গে যুক্ত হন।

এই দলের সদস্যরা ভারতীয় শিল্পের একটি নতুন ধারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যেখানে স্থানীয় ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার একটি মিশ্রণ ছিল।

হুসেনের কাজেও সেই প্রভাব স্পষ্ট ছিল।

তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন, কিন্তু তাঁর ছবিতে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল।

হুসেনের কাজে গ্রামবাংলার জীবন, নারী চরিত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর ছবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তাঁর ছবিতে রঙের ব্যবহার ছিল খুবই উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়।

তবে, তাঁর আঁকা কিছু ছবিতে হিন্দু দেব-দেবীর নগ্ন রূপ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।

রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনেন।

১৯৯০-এর দশকে এই বিতর্ক তীব্র আকার ধারণ করে, যখন হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রসার ঘটে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ে।

হুসেনের শিল্পীজীবন ছিল যেমন বর্ণময়, তেমনই বিতর্কিত।

তিনি শিল্পের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে চেয়েছেন, যা অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

আবার, তাঁর কিছু কাজ সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যা আজও আলোচনার বিষয়।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *