আলো ঝলমলে সমুদ্র! রহস্য ভেদ করতে মরিয়া বিজ্ঞানীরা

গভীর সমুদ্রে এক রহস্য! বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করছেন ‘দুধের সাগর’।

সমুদ্রের গভীরে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী থাকেন নাবিকেরা, যা আজও বিজ্ঞানীদের কাছে এক বিশাল কৌতূহলের বিষয়। রাতের অন্ধকারে বিশাল সমুদ্র জুড়ে আলো ছড়ানোর এই বিরল দৃশ্যকে বিজ্ঞানীরা ‘মিল্কি সি’ বা ‘দুধের সাগর’ নামে অভিহিত করেন। সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা এই রহস্যময় ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে আরও একধাপ এগিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা এই ‘দুধের সাগর’ নিয়ে গবেষণা করছেন এবং এর কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন।

শত শত বছর ধরে নাবিকেরা এই আলো ঝলমলে সমুদ্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। দিগন্ত বিস্তৃত এই আলো প্রায়ই তাদের বিস্মিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৭ সালে আরব সাগরে এস এস ইক্সিয়ন (SS Ixion) নামক জাহাজের এক কর্মকর্তা লিখেছিলেন, “ horizon থেকে horizon পর্যন্ত সমুদ্রের সর্বত্র এক ধরনের দীপ্তি দেখা যাচ্ছিল… চাঁদ ডুবে যাওয়ার পরে পুরো সমুদ্রের জল প্রায় আকাশের চেয়েও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।” ১৯৭৬ সালে এমভি ওয়েস্টমোরল্যান্ড (MV Westmorland) নামক জাহাজের ক্যাপ্টেন পি. ডব্লিউ. প্রাইসও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান, যেখানে তিনি ‘জ্বলজ্বলে সবুজ’ আলো দেখেছিলেন। তাঁর মতে, আলোর তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে সাদা ঢেউ বা সমুদ্রের অস্থিরতা প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না।

সাধারণত মানুষের দৃষ্টির বাইরে, সমুদ্রের দুর্গম অঞ্চলে এই ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। তাই, এই ‘দুধের সাগর’ নিয়ে গবেষণা করা বেশ কঠিন। তবে, বিজ্ঞানীরা এখন এই ঘটনার পূর্বাভাস দিতে এবং এর কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছেন। কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক জাস্টিন হাডসন, ৪০০টিরও বেশি ‘দুধের সাগর’ সম্পর্কিত ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে একটি ডেটাবেস তৈরি করেছেন। এই ডেটাবেস বিজ্ঞানীদের গবেষণা জাহাজ নিয়ে সঠিক সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। এই গবেষণাটি ‘আর্থ অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষক হাডসন জানিয়েছেন, এই ডেটাবেসের মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী ‘দুধের সাগর’ নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা এই রহস্যের সমাধান করতে পারবেন। এই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জানতে পারবেন কেন এই ঘটনা ঘটে এবং এর সমুদ্র জীবনের উপর কী প্রভাব ফেলে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই উজ্জ্বলতার মূল কারণ হলো ‘ভাইব্রো হার্ভেয়ী’ (Vibrio harveyi) নামক এক ধরনের ক্ষুদ্র জীবানু। এই জীবানুগুলি আলো তৈরি করতে পারে। সাধারণত, এই ধরনের ঘটনাগুলো আরব সাগর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রগুলোতে বেশি দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভারত মহাসাগরের অস্থিরতা (Indian Ocean Dipole) এবং এল নিনো (El Niño) -র মতো জলবায়ুগত ঘটনাগুলোর সাথেও এর সম্পর্ক থাকতে পারে।

এই ‘দুধের সাগর’ অন্যান্য সাধারণ আলো-ছড়ানো সমুদ্রের ঘটনা থেকে ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, ডাইনোফ্ল্যাগেলেট (dinoflagellates) নামক এক ধরনের প্ল্যাঙ্কটন আলো তৈরি করে, যা সাধারণত ঢেউয়ের আঘাতে বা কোনো মাছের আনাগোনায় দেখা যায়। কিন্তু ‘দুধের সাগর’-এর আলো অনেক বেশি স্থিতিশীল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো সম্ভবত মাছদের আকৃষ্ট করে এবং তাদের পেটে আশ্রয় নেয়, যার ফলে ব্যাকটেরিয়াগুলো আরও ভালোভাবে বংশবিস্তার করতে পারে।

এই গবেষণা সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের উপর ‘দুধের সাগর’-এর প্রভাব সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ঘটনার উপর কী প্রভাব পড়ে, তা জানতে আগ্রহী। কারণ, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জীবেরা সমুদ্রের খাদ্য শৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই, এই খাদ্য শৃঙ্খলে কোনো পরিবর্তন হলে তা সমুদ্রের অন্যান্য প্রাণী ও বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *