আয়নার মতো কোষ: জীবনের ঝুঁকি? বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা জানাচ্ছেন
বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরণের কোষ তৈরির চেষ্টা করছিলেন যা সম্ভবত জীবনের জন্য এক বিশাল ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। এই কোষগুলো “আয়না কোষ” নামে পরিচিত, যা স্বাভাবিক কোষের একেবারে উল্টো প্রতিরূপ। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কেট আডামালা সহ আরও কয়েকজন গবেষক এই বিষয়ে কাজ করছিলেন। তাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল, জীবনের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে নতুন তথ্য আবিষ্কার করা এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য নতুন ওষুধ তৈরি করা।
কিন্তু তাদের কাজ করতে গিয়ে তারা এক মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হন।
আয়না কোষ তৈরি করার ধারণাটা বেশ জটিল। আমাদের শরীরের কোষগুলোতে বিদ্যমান অণুগুলোর গঠন ডানহাতি বা বামহাতি হয়ে থাকে। এই বৈশিষ্ট্যকে “কাইরালিটি” বলা হয়। বিজ্ঞানীরা যদি এমন একটি “আয়না জীব” তৈরি করতে সক্ষম হন, যার গঠন স্বাভাবিক কোষের সম্পূর্ণ বিপরীত হবে, তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এমন জীব মানবদেহে প্রবেশ করলে তা হয়তো মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে, যা মানবজাতির জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এই বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হন। যেমন, যদি এমন একটি জীব তৈরি করা হয়, তাহলে সেটি কি মানবদেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে? এটি কি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে? নাকি এটি কোনো ক্ষতি না করেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে?
বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এক গভীর উদ্বেগে পড়েন।
প্রকৃতিতে, ডিএনএ এবং আরএনএ-র মতো গুরুত্বপূর্ণ অণুগুলো ডানহাতি আকারের হয়, এবং প্রোটিনগুলো বামহাতি অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে গঠিত। একটি আয়না কোষে, এই অণুগুলোর স্থান হবে উল্টো।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ছোট আকারের আয়না অণুগুলো তেমন কোনো ঝুঁকি তৈরি করে না, এবং এগুলো ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগতে পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ আয়না কোষ তৈরি করা এখনো সম্ভব হয়নি।
২০১৯ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (National Science Foundation) এই গবেষণার জন্য প্রায় ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেয়। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে গবেষণাটি কিছুটা ধীর হয়ে যায়।
এই সময়ে, অন্যান্য বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার পর, কেট আডামালার মনে সন্দেহ জাগতে শুরু করে।
এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের উদ্বেগের কথা জানান। তাদের মতে, আয়না কোষ মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিতে পারে। তাদের মতে, মানুষের শরীরে প্রবেশ করার পর আয়না ব্যাকটেরিয়া দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে, যা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে।
এমনকি সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকও এদের বিরুদ্ধে কাজ করবে না।
২০২৩ এবং ২০২৪ সালের মধ্যে, এই আলোচনাগুলো একত্রিত হয়ে ৩৮ জন বিজ্ঞানীর একটি দল গঠন করে। এই দল “আয়না জীবনের ঝুঁকি মোকাবেলা” শিরোনামে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে “সায়েন্স” জার্নালে প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আগামী ১০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে আয়না কোষ তৈরি হওয়া সম্ভব। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে ছড়িয়ে পড়লে তা ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
বর্তমানে, “মিরর বায়োলজি ডায়ালগস ফান্ড” নামে একটি অলাভজনক সংস্থা এই ঝুঁকির প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন আলোচনা সভা আয়োজন করছে। বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে, আয়না জীব তৈরি করা উচিত হবে না।
তবে, আয়না জীববিজ্ঞানের গবেষণা কতদূর পর্যন্ত সীমিত করা উচিত, সে বিষয়ে এখনো বিতর্ক চলছে।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে বিজ্ঞানীরা একটি সম্মেলনে মিলিত হয়ে, আয়না জীব তৈরির প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা সীমাবদ্ধ করার জন্য “লাল রেখা” নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা করেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড রেলম্যান এই সম্মেলনে বলেন, “আমরা এমন কিছু তৈরি করতে পারি, যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এবং আমাদের সহ অনেক জীব প্রজাতিকে ধ্বংস করে দেবে।”
তবে, কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, এই বিষয়ে গবেষণা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়। তারা বলছেন, আয়না অণু (যেমন প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিড) তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে, যা ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগবে।
ইউটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল কায়ের মতে, “আয়না অণুগুলো হলো নিষ্ক্রিয় রাসায়নিক পদার্থ, যা বিপুল উপকারী হতে পারে।”
অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা সিনথেটিক বায়োলজি (synthetic biology) ব্যবহার করে স্বাভাবিক কাইরালিটি সম্পন্ন সিনথেটিক কোষ তৈরির চেষ্টা করছেন। এই ধরনের কোষ তৈরি করা নিরাপদ হতে পারে, কারণ এটি পরিবেশের স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই চলবে।
বর্তমানে, বিজ্ঞানীরা আয়না রাইবোসোম (ribosome) তৈরি করা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে একমত হয়েছেন। রাইবোসোম হলো কোষের প্রোটিন তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আডামালা এবং তার সহকর্মীরা আয়না কোষের গবেষণা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা এখন এই বিষয়ে নীতি নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিচ্ছেন। তাদের মতে, বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ আয়না কোষ তৈরি করতে সক্ষম হননি।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পর্যায়ে কঠোর নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন।
এই বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যাতে ভবিষ্যতে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হয় যা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন