নয়াদিল্লীর প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় গিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর এই সফর, দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি সহযোগিতা আরও জোরদার করার উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা যখন ভারত এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করছে, সেই প্রেক্ষাপটে মোদীর এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শনিবার কলম্বোর স্বাধীনতা চত্বরে তাঁকে ১৯ তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়।
গত বছর নির্বাচনে জয়লাভের পর, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীই প্রথম কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান যিনি শ্রীলঙ্কা সফর করছেন। মোদীকে শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘মিত্র বিভূষণ’ প্রদান করা হয়েছে।
এই সম্মানকে তিনি শুধু নিজের নয়, ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের সম্মান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে মোদী বলেন, “আমরা মনে করি আমাদের নিরাপত্তা স্বার্থ একই সূত্রে গাঁথা। আমাদের নিরাপত্তা পরস্পরের সঙ্গে নির্ভরশীল।” দুই দেশ পাঁচ বছর মেয়াদী একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে শ্রীলঙ্কার সামরিক কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আদান-প্রদান করার কথা বলা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট এই চুক্তির প্রশংসা করে বলেন, “ভারত শুধু আঞ্চলিক শক্তি নয়, বিশ্ব শক্তি হিসেবেও মাথা তুলছে।” তিনি মোদীকে আরও জানান যে, শ্রীলঙ্কার ভূমি ব্যবহার করে কেউ যেন ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে না পারে, সে বিষয়ে তারা সতর্ক থাকবেন।
ঐতিহাসিকভাবে, ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, চীনের সাবমেরিন এবং গবেষণা জাহাজগুলো কলম্বোর প্রধান বন্দরে ভিড়তে দেখা যায়।
২০১৪ সালের পর থেকে শ্রীলঙ্কা চীনা সাবমেরিনকে ডক করার অনুমতি দেয়নি। এর কারণ হিসেবে ভারতের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়। গত বছর, ভারত অভিযোগ তোলে যে চীনা জাহাজগুলি ভারতের উপর নজরদারি চালাচ্ছে, যার ফলস্বরূপ শ্রীলঙ্কা বিদেশি গবেষণা জাহাজের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিনকোমালী জেলার সম্পদুরে ১২০ মেগাওয়াটের একটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করা।
দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পটি ঝুলে ছিল, তবে ভারতের সহযোগিতায় এটি পুনরায় চালু করা হয়েছে।
কলম্বো থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক মিনেল ফার্নান্দেজ জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ভারতীয় জেলেদের দ্বারা জলসীমা লঙ্ঘনের বিষয়টিও আলোচনা করতে পারেন। ভারতীয় জেলেরা ‘বটম ট্রলিং’-এর মাধ্যমে মাছ ধরে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
মোদীর এই সফর এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন শ্রীলঙ্কা একদিকে নয়াদিল্লি এবং অন্যদিকে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। চীন বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম ঋণদাতা।
দেশটির মোট দ্বিপাক্ষিক ঋণের অর্ধেকের বেশি এখন চীনের কাছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা যখন ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন চীনই প্রথম ঋণ পুনর্গঠনে রাজি হয়েছিল। এরপর শ্রীলঙ্কা তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে ফেরে। সম্প্রতি, শ্রীলঙ্কা চীনের একটি কোম্পানির সঙ্গে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে দেশটির দক্ষিণে একটি তেল শোধনাগার তৈরি করা হবে।
এটি শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে।
এই সফরের আগে মোদী থাইল্যান্ডে একটি সম্মেলনে যোগ দেন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাইছেন।
এই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাংককে অনুষ্ঠিত BIMSTEC (বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) বৈঠকের ফাঁকে, মোদী মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। এছাড়াও, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গেও তাঁর বৈঠক হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, এই প্রথম দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো।
এছাড়াও, মোদী নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা