ট্রাম্পের পথে মোদী! অভিবাসন ইস্যুতে দুই নেতার ‘অভিন্ন’ সুর, কারণ ফাঁস

যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের অভিবাসন নীতি নিয়ে দুটি ভিন্ন চিত্র প্রায়শই দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দুটি দেশের সরকার অনেক ক্ষেত্রেই একই সুরে কথা বলে। সম্প্রতি, ভারতে যখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক বিমানে শিকল পরানো অবস্থায় কয়েকজন ভারতীয়কে ফেরত পাঠানোর ছবি প্রচারিত হলো, তখন বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।

এই ঘটনা প্রমাণ করে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি কিভাবে হাজারো ভারতীয় নাগরিকের জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল, যারা উন্নত জীবনের আশায় আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন।

বিষয়টি নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীসহ অনেকে এই ঘটনার প্রতিবাদে দিল্লিতে সংসদ ভবনের বাইরে বিক্ষোভ করেন। তারা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার দাবি জানান।

কিন্তু মোদী, যিনি তখন হোয়াইট হাউজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, অভিবাসন নিয়ে তেমন কঠোর মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। বরং তিনি জানান, তার সরকার ‘অবৈধ অভিবাসী’দের ফেরত আনতে প্রস্তুত।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মোদীর এই নরম অবস্থান সম্ভবত ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার ভয়ে ছিল। তবে, এর বাইরেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অভিবাসন প্রশ্নে মোদী এবং ট্রাম্পের মধ্যে একটি মিল রয়েছে।

উভয় নেতাই তাদের দেশের উন্নতির জন্য বড় বড় স্বপ্নের কথা বলেন এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা করেন। ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও এর প্রভাব দেখা যায়।

একদিকে অর্থনৈতিক মন্দা, অন্যদিকে দেশের কিছু মানুষের হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা ভারতীয় অভিবাসীদের বিষয়টি মোদীর জন্য একটি উদ্বেগের কারণ। কারণ, এর ফলে ভারতের ‘উন্নয়ন’ এর ধারণাটিতে ফাটল ধরতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা ভারতীয় অভিবাসীদের সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের হিসাব পাওয়া যায়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সাত লাখ ভারতীয় অবৈধভাবে বসবাস করছিলেন, যা মেক্সিকান এবং সালভাদরীয়দের পরেই তৃতীয় স্থানে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র নিরাপত্তা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা দুই লাখ বিশ হাজারের মতো।

তবে, এই সংখ্যা যাই হোক না কেন, এটি ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে একটি ‘উন্নয়নশীল’ দেশের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সম্ভবত, এ কারণেই মোদী দ্রুত এই ‘অবৈধ অভিবাসন’ সংক্রান্ত বিষয়টির মীমাংসা করতে চাইছেন, যাতে ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ভারতের ভাবমূর্তির ক্ষতি না হয়।

ভারতে, বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে, ট্রাম্পের মতোই অভিবাসন বিরোধী মনোভাব দেখা যায়। অনেক বছর ধরেই তারা অবৈধ অভিবাসন, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের আগমন নিয়ে বিভিন্ন কথা বলছেন।

২০১৬ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু দাবি করেছিলেন, ভারতে প্রায় ২ কোটি অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছেন। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই সংখ্যাকে ৪০ মিলিয়নের বেশি বলে উল্লেখ করেন।

২০২৩ সালেও, ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা দাবি করেন, ভারতে প্রায় ৫০ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসী রয়েছে।

তবে, এসব দাবির সপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই।

আসলে, ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের জন্য, তথাকথিত ‘অবৈধ’ মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি একটি শক্তিশালী ধারণা তৈরি করে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে আসা অস্তিত্বের হুমকির বিরুদ্ধে হিন্দু জাতির ধারণাটিকে শক্তিশালী করে।

বাংলাদেশ থেকে আসা ‘অবৈধ অভিবাসন’-এর অভিযোগ, ভারতের ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের জন্য দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য ‘বহিরাগত’দের দোষারোপ করার সুযোগ তৈরি করে।

অমিত শাহ একবার বলেছিলেন, “তারা [বাংলাদেশী অভিবাসীরা] সেই শস্য খাচ্ছে যা গরিবদের পাওয়া উচিত।” তিনি অবৈধ অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।

২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় শাহ আরও বলেছিলেন, বিজেপি সরকার ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ খুঁজে বের করে বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলবে।

এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে হিন্দু জাতির প্রতি একটি ‘জাতিগত চ্যালেঞ্জ’ তৈরির ভয় জাগাতে সহায়ক। দিল্লির বিজেপি ইউনিটের নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় এক টিভি সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ‘অবৈধ’, ‘রোহিঙ্গা’ এবং ‘ধর্মান্তরিত’ মুসলিমদের কারণে হুমকির সম্মুখীন।

এছাড়াও, ভারতের ডানপন্থীদের মধ্যে প্রায়ই শোনা যায়, ‘অবৈধ অভিবাসন’ মানেই অপরাধ। যদিও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় অভিবাসীদের কথা বলেছিলেন, তবে ভারতে কর্তৃপক্ষের দাবি, একটি ‘সুসংগঠিত’ অপরাধ চক্র অবৈধ অভিবাসীদের বাসস্থান, কর্মসংস্থান, জাল জন্ম সনদ এবং অবশেষে ভোটের অধিকার পেতে সহায়তা করে।

এর ফলস্বরূপ, ট্রাম্পের মতো পুলিশি অভিযান ও বিতাড়ন প্রক্রিয়া চালানো হয়, যেখানে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়।

এই ধরনের অভিযানে প্রায়ই বাংলাভাষী মুসলিম ভারতীয় নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কয়েক বছর আগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষের চেয়ে ভারত থেকে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ডানপন্থীদের উত্থানের যুগে এসব কথার কোনো মূল্য নেই।

ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র হোক বা মোদীর ভারত, উভয় জায়গাতেই দেশের ভেতরের সমস্যাগুলোর জন্য বহিরাগতদের দায়ী করা হয়।

এই মানসিকতাই ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন বিরোধী ঢেউ তৈরি করেছে। ভারতে, এটি ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (Citizenship Amendment Act) মতো আইনি পদক্ষেপের ভিত্তি তৈরি করেছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা মুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদী হয়তো হিন্দুত্ববাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তিনি অবৈধভাবে বসবাস করা ভারতীয়দের রক্ষার জন্য ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চান না। অভিবাসন প্রশ্নে তার দৃষ্টিভঙ্গি ট্রাম্পের মতোই, এবং অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি তার কোনো সহানুভূতি নেই, এমনকি তারা ভারতীয় নাগরিক হলেও।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *