আতঙ্ক! মরক্কোর বিতাড়ন: প্রতিবেশী দেশগুলিতে অভিবাসীদের কান্না

**পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার অভিবাসন নীতি: বিতর্কের ঝড়**

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়া সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশগুলোতে, বিশেষ করে সেনেগাল ও মালিতে, ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীকে ফেরত পাঠাচ্ছে।

এই ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র নিন্দা জানিয়েছে, এবং প্রতিবেশী দেশগুলো একে ‘জাতিবিদ্বেষী’ পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই বিতর্কের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেরত পাঠানো অভিবাসীদের মধ্যে অনেকের কাছে বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের জোর করে সীমান্ত পার করে দেওয়া হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গত কয়েক মাসে কয়েক’শ মানুষকে এভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

মৌরিতানিয়ার মানবাধিকার সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস’ (AMDH)-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু মার্চ মাসেই প্রায় ১,২০০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৭০০ জনের বসবাসের অনুমতি ছিল।

ফেরত পাঠানো অভিবাসীরা জানিয়েছেন, তাদের প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।

এরপর তাদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, পর্যাপ্ত খাবার ও জল ছাড়া দিনের পর দিন বন্দী করে রাখা হয়।

এমনকি অনেককে নির্যাতনের শিকারও হতে হয়েছে।

মৌরিতানিয়া মূলত একটি মরুভূমি অঞ্চল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) সঙ্গে দেশটির একটি চুক্তি রয়েছে, যার মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অভিবাসনপ্রবণতা কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

মৌরিতানিয়া কর্তৃপক্ষের দাবি, মানব পাচার চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু এই পদক্ষেপের কারণে প্রতিবেশী দেশ মালি ও সেনেগালের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

মালির সরকার এক বিবৃতিতে তাদের নাগরিকদের প্রতি এই ধরনের আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং গ্রেফতারের পদ্ধতিকে মানবাধিকার ও অভিবাসীদের অধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে।

সেনেগালের সংসদ সদস্যরাও এই ঘটনাকে ‘জাতিবিদ্বেষী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং সরকারের প্রতি ঘটনার তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এর অভিবাসন গবেষক হাসান ওল্ড মোক্তার আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, “অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তবে এত বেশি সংখ্যক মানুষকে ফেরত পাঠানো এবং সহিংসতার মাত্রা আগে দেখা যায়নি।”

গবেষক মনে করেন, এর পেছনে মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) চাপ রয়েছে।

একদিকে, ব্রাসেলস থেকে মৌরিতানিয়াকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে, ইউরোপ থেকে বিতাড়িত অভিবাসীদের মৌরিতানিয়ায় পুনর্বাসন করার গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে, যদিও মৌরিতানিয়া সরকার এই ধরনের কোনো চুক্তির কথা অস্বীকার করেছে।

আফ্রিকা থেকে স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার জন্য মৌরিতানিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ ইউরোপের কাছাকাছি হওয়ায় অভিবাসীরা নৌপথে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে।

এ কারণে, ২০০০ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) মৌরিতানিয়া, মরক্কো ও সেনেগালের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে এবং অভিবাসন রোধে সহায়তা করছে।

কিন্তু গত বছর মৌরিতানিয়া থেকে ইউরোপে অভিবাসনপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ইইউ নতুন করে সক্রিয় হয়েছে।

একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, জানুয়ারী ২০২৪-এ ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছানো প্রায় ৭,২৭০ জনের মধ্যে ৮৩ শতাংশই মৌরিতানিয়া হয়ে এসেছিল।

যা ২০২৩ সালের জানুয়ারীর তুলনায় ১,১৮৪ শতাংশ বেশি।

এছাড়া, একই সময়ে মৌরিতানিয়া থেকে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার সময় প্রায় ৩,৬০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, সাহেল অঞ্চলে, বিশেষ করে মালি ও নাইজারে, বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই অভিবাসন বাড়ছে।

সম্প্রতি, মালিতে সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের কারণে সেখানকার অনেক মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে মৌরিতানিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে।

সেনেগালের রেড ক্রসের প্রতিনিধি ইব্রাহিম ড্রামে আল জাজিরাকে জানান, নতুন একটি অভিবাসন আইন কার্যকর হওয়ার পর, যেখানে বসবাসের জন্য অনুমতিপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, জানুয়ারী মাস থেকে অভিবাসীদের আটকের ঘটনা বেড়েছে।

তবে, অনেকেরই এই অনুমতি পাওয়ার সুযোগ হয়নি।

ড্রামে আরও বলেন, “রাতের বেলাতেও বাজারে, বাসস্ট্যান্ডে এবং প্রধান রাস্তাগুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে।”

তিনি জানান, আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তার অভাবে টোগো, নাইজেরিয়া, নাইজার, গাম্বিয়া, গিনি-বিসাউ, গিনি কোনাক্রি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, ঘানা ও বেনিনের অভিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মৌরিতানিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এই নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

তারা মনে করছেন, বিতাড়ন অভিযান তাদের প্রতিও লক্ষ্য হতে পারে।

মানবাধিকার কর্মী আব্দুলায়ে সো-এর মতে, মৌরিতানিয়ার এই পরিস্থিতিতে সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর উদ্বেগের কারণ বুঝতে হলে দেশটির অতীতের দিকে তাকাতে হবে।

ঐতিহাসিকভাবে, মৌরিতানিয়া শ্বেতাঙ্গ-আরব নেতৃত্বাধীন একটি সমাজ ব্যবস্থা বজায় রেখেছে, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ওপর বিভিন্ন সময়ে নিপীড়ন হয়েছে।

১৯৮১ সালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও, এর রেশ এখনও রয়ে গেছে।

অতীতে কৃষ্ণাঙ্গ মৌরিতানিয়ানদেরও নির্বিচারে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

১৯৮৯ সালে মৌরিতানিয়ার রাখাল ও সেনেগালের কৃষকদের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধের জেরে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।

সেই সময় মৌরিতানিয়ার সরকার সেনেগালের নাগরিকদের এবং কৃষ্ণাঙ্গ মৌরিতানিয়ানদের ওপর নিপীড়ন চালায়।

আব্দুলায়ে সো জানান, বর্তমানে অভিবাসীদের বিতাড়নের ঘটনা তাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করেছে।

তিনি সরকারের কাছে চিঠি লিখে এই বিষয়ে উদ্বেগ জানালেও, কোনো সাড়া পাননি।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন der লেয়েন ফেব্রুয়ারী মাসে মৌরিতানিয়া সফর করেন এবং দেশটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ২১০ মিলিয়ন ইউরোর (প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা) একটি ‘অভিবাসন অংশীদারিত্ব চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন।

এই চুক্তির মাধ্যমে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার এবং মানব পাচার নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার কথা বলা হয়েছে।

ইইউ এই বছর অভিবাসীদের খাদ্য, চিকিৎসা ও মানসিক সহায়তা দেওয়ার জন্য আরও ৪ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৪৬ কোটি টাকা) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *