বার্মার শিল্পী হেইন লিনের কারাজীবনের চিত্রকর্ম: নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদের গল্প।
বার্মার শিল্পী হেইন লিন, যিনি একাধারে চিত্রকর, ভাস্কর এবং পরিবেশ শিল্পী হিসেবে পরিচিত, তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কারাজীবনের বিভীষিকা আর মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য ক্ষমতা। গণতন্ত্রের দাবিতে ১৯৮৮ সালের আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।
সেই সময় মিয়ানমারের কারাগারের ভেতরেই তিনি সৃষ্টি করেন অসংখ্য শিল্পকর্ম, যা আজও শিল্পকলার জগতে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ক্যানভাসের অভাবে কারাগারের পোশাক, আর তুলির বদলে সিরিঞ্জ, সাবান, লাইটারের মতো সাধারণ জিনিস ব্যবহার করে তিনি এঁকেছেন মানুষের ভেতরের কষ্ট আর প্রতিরোধের ছবি।
হেইন লিনের জন্ম ১৯৬৬ সালে, বার্মার ইনগাপু শহরে। ১৯৮৮ সালের গণতন্ত্রপন্থী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ছিলেন। কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রায় এক হাজার ছবি ও স্কেচ তৈরি করেন, যার মধ্যে কিছু ছবি তিনি গোপনে বাইরে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বর্তমানে তাঁর প্রায় ২৩০টি চিত্রকর্ম টিকে আছে, যা নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক সামাজিক ইতিহাস ইনস্টিটিউটে সংরক্ষিত রয়েছে।
বার্মিজ শিল্পী হেইন লিনের কাজের মূল বিষয় হলো মানুষের কষ্ট, নিপীড়ন আর সেই কষ্টের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা।
তাঁর কাজের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ‘সিটিং অ্যাট আয়রন গেট’ (২০০২) যেখানে লোহার ফটকের কাছে বসে থাকা বন্দী মানুষের একাকীত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া ‘বায়োলজি অফ আর্ট’ (১৯৯৯) নামক ছবিতে তিনি টুথপেস্টের টিউব, ওষুধের বোতল এবং পিল প্যাকেট ব্যবহার করে মানুষের শরীরের গঠন ফুটিয়ে তুলেছেন, যা শিল্পকলার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
কারাজীবনের দুঃসহ স্মৃতিগুলো শিল্পী তাঁর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত করে তুলেছেন।
হেইন লিনের কাজের গভীরতা শুধু তাঁর শিল্পকর্মে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সঙ্গে মিশে আছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি যেন তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতে বিদ্যমান।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, বহু মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অং সান সু চিও।
বর্তমান পরিস্থিতিতে হেইন লিন নিজেও দেশ ছাড়তে পারছেন না, কারণ তাঁর পাসপোর্ট নেই। তাঁর স্ত্রী, যিনি ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তাঁকেও দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এই দম্পতি বর্তমানে দুই বছর ধরে আলাদা থাকছেন।
হেইন লিনের কাজগুলো বার্মার মানুষের দুঃখ-কষ্ট, তাঁদের প্রতিরোধ এবং ঘুরে দাঁড়ানোর এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত। তাঁর শিল্পকর্ম শুধু একটি দেশের মানুষের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এটি সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদের ভাষা।
বর্তমানে বার্মিংহামের আইকন গ্যালারিতে তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে ‘এস্কেপ’ (Escape) নামে একটি প্রদর্শনী চলছে। যদিও পাসপোর্ট না থাকার কারণে শিল্পী নিজে সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি, তবুও তাঁর কাজগুলো মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করেছে।
হেইন লিনের ভাষায়, “বিশ্ব হয়তো মিয়ানমারের পরিস্থিতি বুঝতে পারে না, তবে তারা সেদিকে মনোযোগ দেয় না।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।