বিশ্বজুড়ে প্রতারণার জাল: ধরপাকড়ের পরেও বাড়ছে জালিয়াত চক্রের দৌরাত্ম্য

শিরোনাম: মিয়ানমারের সীমান্ত জুড়ে প্রতারণার জাল: বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে সাইবার জালিয়াতির ফাঁদ

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা প্রতারণা কেন্দ্রগুলো বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যেমন এখানকার সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রগুলো সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, তেমনই এই চক্রগুলোর সঙ্গে জড়িত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দৌরাত্ম্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

সম্প্রতি, মিয়ানমারের সীমান্ত থেকে প্রায় ৭,০০০ জনকে মুক্তি দেওয়া হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জালিয়াতির বিস্তার এখনই থামবে না। বরং, প্রযুক্তির সহায়তায় এটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতারক চক্রগুলো মূলত মানব পাচারের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ করে। ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অথবা অন্যান্য আকর্ষণীয় সুযোগের কথা বলে, তাদের মিয়ানমারে নিয়ে আসা হয়।

এরপর সেখানে তাদের বিনিয়োগ স্কিম এবং প্রেমের ফাঁদের (রোমান্স স্ক্যাম) মতো প্রতারণামূলক কাজে নিয়োজিত করা হয়। এই কেন্দ্রগুলো মূলত মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে অবস্থিত।

যেমন, ক্যাসিনো এবং অনলাইন জুয়ার নামে পরিচিত ‘কে কে পার্ক’-এর মতো বিশাল এলাকা এই ধরনের জালিয়াতির আখড়া হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারণা চক্রগুলো এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)।

এআই ব্যবহার করে তারা প্রতারণার স্ক্রিপ্ট তৈরি করছে এবং গভীর জাল (deepfake) প্রযুক্তির মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির ছদ্মবেশ ধারণ করছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (UNODC)-এর মতে, এই পরিস্থিতি আগে কখনও দেখা যায়নি এবং এটি দ্রুত আরও বিপজ্জনকের দিকে যাচ্ছে।

শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, এই ধরনের জালিয়াতির বিস্তার আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাতেও দেখা যাচ্ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই চক্রগুলো দ্রুত শক্তিশালী সাইবার হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তারা ম্যালওয়্যার, ডিপফেক এবং অন্যান্য শক্তিশালী সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারদর্শী।

ভুক্তভোগীদের দুর্দশা সত্যিই হৃদয়বিদারক। প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই তাদের জীবনের সঞ্চয় হারিয়েছেন। মুক্তি পাওয়া কয়েকজনের ভাষ্য অনুযায়ী, যারা কাজ করতে অস্বীকার করে বা তাদের দেওয়া লক্ষ্য পূরণ করতে পারে না, তাদের ওপর চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন।

এমনকি, মুক্তি পাওয়ার জন্য মুক্তিপণ দিতে হয় অথবা অন্য কাউকে তাদের জায়গায় কাজ করতে রাজি করাতে হয়।

থাইল্যান্ডের এক আইনপ্রণেতা কান্নাভী সুয়েবসং জানিয়েছেন, মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই এখনও থাইল্যান্ডের আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের দেশে ফেরত পাঠানোও একটি কঠিন প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগে রয়েছেন।

এই সমস্যা মোকাবিলায় একটি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ, একটি দেশের পক্ষে এই বিশাল জাল বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতারণার কারণে বছরে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪,৭০০ বিলিয়ন বাংলাদেশি টাকা, *জুলাই ২৬, ২০২৩ তারিখের বিনিময় হার অনুযায়ী*) ক্ষতি হচ্ছে, যা এই অঞ্চলের কয়েকটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। দেশটির সামরিক জান্তা এবং বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে, জালিয়াত চক্রগুলো তাদের কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করা কঠিন।

তথ্য সূত্র: CNN

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *