নাগরিকত্বের প্রমাণ: ভোটাধিকারের পথে নতুন চ্যালেঞ্জ?

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে নাগরিকত্বের প্রমাণ সাপেক্ষে ভোটার আইডি কার্ড তৈরি করার প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে রিপাবলিকান পার্টি-নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোতে এই ধরনের পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে, যদিও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সংক্রান্ত ফেডারেল স্তরের প্রস্তাবগুলো খুব একটা সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বর্তমানে ২২টি রাজ্যে ভোটার নিবন্ধনের সময় নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়া সংক্রান্ত আইন তৈরির বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সম্প্রতি, ওয়াইওমিং রাজ্যে এই ধরনের একটি নীতি কার্যকর করা হয়েছে। ভোটদান-সংক্রান্ত আইন নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার মতে, চার বছর আগেও মাত্র ৬টি রাজ্যে এই ধরনের বিলের ওপর আলোচনা হয়েছিল। এর থেকে বোঝা যায়, কিছু রিপাবলিকান সদস্য এই ইস্যুকে জোরালোভাবে তুলে ধরছেন। তাদের দাবি, বিদেশি নাগরিকরা যেন কোনোভাবেই ভোট দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করা দরকার। যদিও সমালোচকদের মতে, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই ধরনের আইন তৈরির প্রচেষ্টা চলছে, যেখানে ট্রাম্পসহ জাতীয় পর্যায়ের রিপাবলিকান নেতারাও এই প্রস্তাবকে সমর্থন করছেন। তবে ফেডারেল স্তরে এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন, কারণ এতে আইনি, প্রশাসনিক এবং লজিস্টিক সমস্যা রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে এরই মধ্যে নাগরিকত্বের প্রমাণ চেয়ে একটি বিল পাস হয়েছে, যা গত বছর উত্থাপিত একটি প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি। তবে ডেমোক্র্যাটদের বাধার কারণে সিনেটে এটি পাস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যিনি তার পরাজয়ের জন্য ভোটের কারচুপির অভিযোগ তুলেছিলেন, গত মাসে স্থানীয় সরকার এবং রাজ্যগুলোতে নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এই আদেশে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়ার বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়।

ট্রাম্পের এই আদেশের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে কয়েকটি মামলা হয়েছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, এটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন। এছাড়া, আদালত জানিয়েছে, ফেডারেল নির্বাচন কমিশনকে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়ার বিষয়টি উৎসাহিত করতে ট্রাম্পের নির্দেশনা একটি প্রস্তাবের মতো, যা বাস্তবায়নের আগে অনেক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। এমনকি, কমিশনের অন্তত একজন ডেমোক্র্যাট সদস্যের সমর্থনও প্রয়োজন হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে রিপাবলিকান রাজ্যের আইনপ্রণেতাদের কাছে একটি বার্তা পাঠানো হয়েছে। ভোটের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার উপদেষ্টা জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট চাইছেন, সারা দেশে তার সমর্থকরা যেন এই বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যান।

যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, বিদেশি নাগরিকদের ফেডারেল নির্বাচনে ভোট দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কেউ এই আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে কারাদণ্ড এবং বিতাড়নের মতো শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন। বর্তমানে অধিকাংশ রাজ্যে ভোটাররা একটি হলফনামায় স্বাক্ষর করে তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দেন। তবে সমালোচকরা বলছেন, জন্ম সনদ বা পাসপোর্টের মতো নথি জমা দেওয়ার নিয়ম চালু হলে, অনেক আমেরিকান ভোটার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। কারণ, অনেকের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নাও থাকতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের একটি গবেষণা বলছে, প্রায় ৯ শতাংশ যোগ্য ভোটারের (প্রায় ২ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ) প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে সমস্যা হতে পারে এবং ২ শতাংশের কাছে কোনো কাগজপত্র নেই।

তবে, বিদেশি নাগরিকদের ভোট দেওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। সম্প্রতি, আইওয়া রাজ্যে ভোটারদের তালিকা নিরীক্ষণের পর জানা গেছে, তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ২.১ মিলিয়ন ভোটারের মধ্যে ২৭৭ জন বিদেশি নাগরিক ছিলেন। তাদের মধ্যে ৩৫ জন গত নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন।

কানসাসে ২০১১ সালে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়, যেখানে ভোটারদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে বলা হয়েছিল। এর ফলে, প্রায় তিন বছরে ৩১ হাজার ভোটারের নিবন্ধন বাতিল করা হয়, কারণ তারা নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পারেননি।

বিরোধীরা বলছেন, রিপাবলিকানদের এই পদক্ষেপের ফলে দরিদ্র, বয়স্ক এবং বিবাহিত নারীদের ভোট দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, তাদের জন্ম সনদে নামের সঙ্গে বর্তমান নামের মিল নাও থাকতে পারে। তবে, বিলের সমর্থকরা বলছেন, রাজ্যগুলো চাইলে বিয়ের সনদসহ অন্যান্য নথি গ্রহণ করে এই সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারে।

নিউ হ্যাম্পশায়ারের একজন ভোটার জানান, তিনি তার পাসপোর্ট সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন না।

নিউ হ্যাম্পশায়ারে সম্প্রতি নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়ার নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। এই কারণে, নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে অনেককে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একটি সংস্থার মতে, ওই দিনের নির্বাচনে অন্তত ৯৬ জন ভোটারের ভোট দিতে সমস্যা হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য রাজ্যগুলোর নিউ হ্যাম্পশায়ারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।

নিউ হ্যাম্পশায়ারের একজন আইনপ্রণেতা জানিয়েছেন, যারা আগে থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেননি, তাদের ভোট দিতে সমস্যা হয়েছে।

বর্তমানে, নিউ হ্যাম্পশায়ারে আরেকটি বিলের ওপর আলোচনা চলছে, যেখানে ডাকযোগে পাঠানো ভোটের ক্ষেত্রেও নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের জনবহুল রাজ্যগুলোতেও এই ধরনের আইন পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। ফ্লোরিডার আইনসভায় একটি বিল আনা হয়েছে, যেখানে প্রথমবার ভোটারদের জন্ম সনদ, পাসপোর্ট বা ন্যাচারালাইজেশন ডকুমেন্টের মতো সাত ধরনের আইডি-র মাধ্যমে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। এমনকি, ভোটার আইডি কার্ডে কোনো পরিবর্তন করতে গেলেও প্রমাণ জমা দিতে হবে।

টেক্সাস রাজ্যে একটি বিল পাস হয়েছে, যেখানে ভোটার নিবন্ধনের জন্য নাগরিকত্বের প্রমাণ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু নতুন ভোটার নয়, রাজ্যের ১ কোটি ৮০ লক্ষ ভোটারের নাগরিকত্বের তথ্য যাচাই করার জন্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের ফেডারেল ও রাজ্য ডেটাবেস ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

টেক্সাসের একজন সিনেটর বলেছেন, “আমরা সবাই একমত যে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কেবল মার্কিন নাগরিকদের জন্য। তবে ফেডারেল সরকার রাজ্যগুলোকে নিবন্ধনের সময় নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়ার অনুমতি দেয়নি।”

যাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ পাওয়া যাবে না, তাদের জন্য একটি সীমিত ফেডারেল ব্যালটের ব্যবস্থা করা হবে, যার মাধ্যমে তারা কেবল কংগ্রেসের প্রার্থীদের জন্য ভোট রাখতে পারবেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, তারা প্রেসিডেন্ট, রাজ্য ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না।

আইনজীবীরা বলছেন, টেক্সাসের এই পদক্ষেপ ফেডারেল আইনের পরিপন্থী। কারণ, ফেডারেল নির্বাচন কমিশনই ফেডারেল ফর্ম পরিবর্তন করতে পারে, টেক্সাস নয়।

বিভিন্ন রাজ্যে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়ার এই প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, এর ফলে অনেক যোগ্য আমেরিকান ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *