নৈরোবি শহরে অনুষ্ঠিত ‘পারিবারিক মূল্যবোধ বিষয়ক’ একটি সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এই সম্মেলনে ঐতিহ্য রক্ষার নামে রক্ষণশীল কিছু ধ্যান-ধারণা প্রচার করা হয়েছে, যা আফ্রিকার সংস্কৃতিতে ঔপনিবেশিক প্রভাবের ফলস্বরূপ বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্মেলনে বক্তারা পরিবার ও সমাজের চিরাচরিত রীতিনীতি রক্ষার কথা বললেও, সমালোচকদের মতে, এর পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর রক্ষণশীল সংগঠনগুলোর হাত রয়েছে, যারা এলজিবিটিকিউ অধিকার, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অবাধ যৌন শিক্ষার বিরোধিতা করে।
আফ্রিকা মহাদেশে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ঐতিহ্য রক্ষার নামে প্রায়ই এমন কিছু বিষয় উপস্থাপন করা হয়, যা মূলত ঔপনিবেশিক শাসন ও মিশনারি কার্যক্রমের ফল।
এর পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন এবং তাদের আর্থিক সহায়তা কাজ করে, যাদের মূল লক্ষ্য হল সমাজের উপর কিছু কঠোর ও বিভাজন সৃষ্টিকারী মূল্যবোধ চাপানো, যা আফ্রিকার বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
নৈরোবিতে অনুষ্ঠিত ‘প্যান-আফ্রিকান কনফারেন্স অন ফ্যামিলি ভ্যালুস’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ ছিল এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
এই সম্মেলনে ‘আফ্রিকান পারিবারিক মূল্যবোধ’ রক্ষার কথা বলা হলেও, এর উদ্যোক্তা ‘আফ্রিকা খ্রিস্টান প্রফেশনালস ফোরাম’-এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন কিছু সংগঠনের, যারা এলজিবিটিকিউ অধিকার, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বিস্তারিত যৌন শিক্ষার ঘোর বিরোধী।
এমনকি, এই সম্মেলনের বক্তাদের তালিকায় শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের আধিক্য নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
এই সম্মেলনগুলোতে প্রায়শই এমন একটি ধারণা প্রচার করা হয়, যেন ঐতিহ্য মানেই অপরিবর্তনীয় কিছু এবং এর মাধ্যমে আফ্রিকার আদি সংস্কৃতিকে রক্ষা করা সম্ভব।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এই ধারণা ঔপনিবেশিক শাসনের সময় তৈরি হওয়া ধারণারই পুনরাবৃত্তি।
ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের শাসনকে বৈধতা দিতে গিয়ে আদি সংস্কৃতিকে ‘সভ্য’ করার নামে সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা ও কঠোর সামাজিক নিয়ম চাপিয়ে দেয়।
একইসঙ্গে, তারা এমন কিছু ‘ঐতিহ্য’ তৈরি করে, যা তাদের শাসনকে সমর্থন করে।
ঐতিহ্য রক্ষার নামে এই ধরনের সম্মেলনের আয়োজন নতুন নয়।
অতীতেও দেখা গেছে, স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সরকারগুলো রাজনৈতিক ফায়দা বা নিজেদের রক্ষণশীল আদর্শের কারণে এই ধরনের কার্যক্রমকে সমর্থন করে।
অনেক ক্ষেত্রে, কিছু এনজিও-ও এই ধরনের কার্যক্রমকে সমর্থন করে, যা তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়, তবে এর পেছনে থাকা ঔপনিবেশিক শিকড়গুলো প্রায়ই ঢাকা পড়ে যায়।
নৈরোবি সম্মেলনে কেনিয়া রেড ক্রস সোসাইটি (কেআরসিএস)-এর একটি হোটেল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
যদিও কেআরসিএস সরাসরি সম্মেলনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে, তবে এই ঘটনা মানবিক সংস্থাগুলোর জন্য একটি সতর্কবার্তা।
কারণ, অনেক সময় ভালো উদ্দেশ্যে কাজ করা সংস্থাগুলোও অজান্তে ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণাকে সমর্থন করে ফেলতে পারে।
আফ্রিকার এই প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের জন্য খুব অচেনা নয়।
আমাদের দেশেও ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে আমাদের সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
আজও, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্বে আমরা প্রায়ই দেখি, কীভাবে বাইরের সংস্কৃতি আমাদের সমাজে প্রভাব বিস্তার করে।
তাই, ঐতিহ্য রক্ষার নামে যখন কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়, তখন এর পেছনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ভালোভাবে বুঝতে হবে।
আফ্রিকায় ‘ডি-কলোনাইজেশন’ এবং ‘ডি-কলোনিয়ালিটি’র ধারণা দুটি গুরুত্বপূর্ণ।
‘ডি-কলোনাইজেশন’ বলতে বোঝায় ক্ষমতা হস্তান্তর, যেখানে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়।
অন্যদিকে, ‘ডি-কলোনিয়ালিটি’ হলো ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও মূল্যবোধের অবসান ঘটানো।
এই দুটি ধারণার মধ্যে পার্থক্য বোঝা জরুরি, কারণ অনেক সময় ডি-কলোনাইজেশনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরও, সমাজে ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণাগুলো থেকে যায়।
এর ফলে, ঐতিহ্য রক্ষার নামে এমন কিছু বিষয় সামনে আসে, যা আসলে পুরনো ঔপনিবেশিক চিন্তাধারারই প্রতিরূপ।
অতএব, আমাদের বুঝতে হবে, ঐতিহ্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যেন কোনো নিপীড়নমূলক কার্যক্রম না চলে।
বরং, ঐতিহ্য হোক আমাদের ঐক্য ও উন্নতির প্রতীক।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা