গাজায় ‘নাকবা’, যা আজও থামেনি: উদ্বাস্তু জীবনের এক বেদনাদায়ক চিত্র।
১৯৪৮ সালের ১৫ই মে, সাইদ নামের এক ছোট্ট শিশুর বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। ফিলিস্তিনের বীরশাবা শহরে জায়নবাদী মিলিশিয়াদের হামলায় তার পরিবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। মা কোলে তুলে নিয়ে সাইদকে নিয়ে ছুটেছিলেন, পেছনে তখন অবিরাম বোমা ও গুলির শব্দ।
উদ্বাস্তু হয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন গাজা শহরে। প্রথমে ভেবেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই হয়তো আবার ফিরে যেতে পারবেন নিজেদের বাড়ি-জমিতে, কিন্তু সেই ‘কয়েক দিন’ যে দশকের পর দশক ধরে দীর্ঘ হতে থাকবে, তা কে জানত!
বাবা-মায়ের হাত ধরে উদ্বাস্তু হওয়া সাইদের সেই ছোট্টবেলা কেটেছে উদ্বাস্তুর মতোই। উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষগুলোর জন্য গড়া অস্থায়ী তাঁবুগুলো একসময় স্থায়ী কংক্রিটের আশ্রয়ে পরিণত হয়। ভিটেমাটির চাবিগুলো মরিচা ধরে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রইল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের ‘ফিরে আসার অধিকার’-এর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাইদের চোখে, ‘নাকবা’ ছিল একটি অতীত, যা তিনি তাঁর দাদার মুখে শোনা গল্প থেকে জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে তিনি যেন নিজের চোখেই সেই ‘নাকবা’র বাস্তব রূপ দেখতে শুরু করলেন, যা স্মার্টফোন আর টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিনিয়ত ভেসে আসে।
যাদের কারণে তাঁর দাদাকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল, সেই মিলিশিয়ারা এখন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাদের হাতে আধুনিক অস্ত্রের মজুদ, যা দিয়ে তারা অবরুদ্ধ গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে।
গাজার মানুষ কেবল স্বাধীনতা আর সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চায়। অক্টোবর ২০২৩-এ ইসরায়েল নতুন করে যে বাস্তুচ্যুতি অভিযান শুরু করেছে, তা যেন সাইদের দাদার সেই পুরোনো অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি। উত্তর গাজার বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যেতে বলা হলো, কিন্তু সেখানেও বোমাবর্ষণ চলল।
পরিবারের সদস্যরা দিনের পর দিন খালি পায়ে হেঁটেছে, সঙ্গে ছিল সামান্য কিছু জিনিসপত্র। আবারও তাঁরা আশ্রয় নিয়েছে তাঁবুতে, যা তৈরি হয়েছে কাপড় আর নানা ধরনের আবর্জনা দিয়ে।
বুলেটের আঘাত ছাড়াই সেখানে মৃত্যু যেন নিত্যদিনের ঘটনা। ঠান্ডায় ও অপুষ্টিতে নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। পোলিও, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ, যা বিশ্ব থেকে প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে আবার ফিরে এসেছে।
ইসরায়েল খাদ্য, ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়ে অবরোধ আরও কঠোর করেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৯৬ শতাংশ মানুষ এখন খাদ্য সংকটে ভুগছে, যার মধ্যে অনেকে মারাত্মক অপুষ্টির শিকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অন্তত ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বিদ্যুৎ নেই, খাবার পানি নেই, রান্নার জন্য কাঠ অথবা মাটির চুলা ব্যবহার করতে হয়। ধোঁয়ায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যা মায়েদের ফুসফুসে জমাট বাঁধে, আর শিশুরা খালি পেটে ঘুমোতে যায়।
গাড়িগুলোর বদলে এখন সেখানে দেখা যায় গাধা টানা গাড়ি, যা হয় ধ্বংস হয়ে গেছে, না হয় জ্বালানি সংকটের কারণে অচল হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের এই আগ্রাসন শুধু তাদের ভূমি কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে জীবনের মৌলিক অধিকারগুলোও।
প্রথম ‘নাকবা’র সাক্ষী সাইদের দাদা দ্বিতীয় ‘নাকবা’র যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেননি। এক বছর ধরে সীমাহীন কষ্ট, ক্ষুধা ও চিকিৎসার অভাবে তিনি গত অক্টোবরে মারা যান। কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর শরীরের অর্ধেক ওজন কমে গিয়েছিল।
এককালের শক্তিশালী, সুঠাম মানুষটি কঙ্কালে পরিণত হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন, কোনো ওষুধ বা ভালো খাবার ছিল না, কোনো স্বস্তি ছিল না। ১১ই অক্টোবরের সেই বিদায় মুহূর্ত আজও তাঁর মনে আছে।
নীরবে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি, তাঁর গালে গড়িয়ে পড়া অশ্রু যেন অনেক যুদ্ধের সাক্ষী হওয়া একজন মানুষের নীরব আর্তি ছিল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে গাজা থেকে ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করার কথা বলেছেন। তাঁর এই বক্তব্য যেন পুরোনো ইসরায়েলি পরিকল্পনারই পুনরাবৃত্তি, যা এখন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছে।
উদ্বাস্তু করার এই পরিকল্পনার মোড়কে ‘স্বেচ্ছায় স্থানান্তরের’ কথা বলা হলেও, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গাজায় জীবন ধারণের পরিবেশ কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ১লা জুলাই পর্যন্ত গাজার ৮৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয় ধ্বংস হয়ে গেছে, না হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে ৩২টিই অন্তর্ভুক্ত।
শিক্ষাখাতেও একই বিপর্যয় নেমে এসেছে। ইউনিসেফের মতে, গাজার ৮০ শতাংশ স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর চালু নেই এবং অন্তত ৯৪ জন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের সংস্থা UNRWA (ইউএনআরডব্লিউএ), যা মূল ‘নাকবা’র পর থেকে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের সাহায্য করে আসছে, তাদের কার্যক্রমও বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ইসরায়েলের পার্লামেন্ট ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইউএনআরডব্লিউএ-এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে।
একইসঙ্গে তারা খাদ্য গুদামে বোমা হামলা চালিয়েছে এবং সাহায্যকারী দেশগুলোর ওপর তহবিল বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। কেন? কারণ ইউএনআরডব্লিউএ-এর অস্তিত্ব উদ্বাস্তুদের ‘ফিরে আসার অধিকার’-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসরায়েল চায় এই স্মৃতি মুছে ফেলতে।
শরণার্থী শিবিরগুলো, যা এই অধিকারের প্রতীক, বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। উত্তর গাজার জাবালিয়া ও শাতি এবং দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস ও রাফাহর মতো শিবিরগুলো এখন গণকবরে পরিণত হয়েছে।
একসময় যেখানে স্বপ্ন আর প্রতিরোধের জন্ম হয়েছিল, সেখানে এখন কেবল তাঁদের কঙ্কাল রয়েছে, যাঁরা নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়তে রাজি হননি।
তাহলে প্রশ্ন হলো, সাইদের দাদার নিজের ভূমিতে ফিরে আসার স্বপ্ন কি কোনোদিন সত্যি হবে? নাকি ইতিহাস তার নিষ্ঠুর চাকা ঘোরাতেই থাকবে, আর উদ্বাস্তু ও দুঃখের নতুন অধ্যায় রচিত হবে?
সাইদ কি তাঁর সন্তানদের একদিন তাঁর দাদার মতো তাঁদের ‘নাকবা’ আর ফিরে আসার স্বপ্নের কথা বলতে পারবেন?
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা