নারীদের পোশাক: পকেটের এই বঞ্চনা কেন?
পোশাক-পরিচ্ছদ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পোশাকের ডিজাইন, স্টাইল এবং এর ভেতরের নানা অনুষঙ্গ আমাদের সংস্কৃতি, রুচি এবং সামাজিক ধারণাকে প্রতিফলিত করে।
পোশাকের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল পকেট। পুরুষদের পোশাকে যেখানে পকেটের ছড়াছড়ি, সেখানে নারীদের পোশাকে প্রায়ই এর অভাব দেখা যায়। কেন এই বৈষম্য? পোশাকের জগতে নারী-পুরুষের এই বিভাজন আসলে কিসের ইঙ্গিত দেয়?
বিষয়টি যদি একটু গভীরে যাওয়া যায়, তবে দেখা যায়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। অতীতে, পুরুষদের পোশাকে পকেট ছিল খুবই সাধারণ একটি বিষয়।
পঞ্চদশ শতকে পুরুষদের ব্রিচেসে (পুরুষদের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা পায়জামা) সেলাই করা হতো পকেট। ধীরে ধীরে, পোশাক তৈরির উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের জন্য তৈরি পোশাকে পকেটের ব্যবহার আরও বাড়ে। অন্যদিকে, নারীরা সাধারণত কোমরবন্ধে বাঁধা ছোট থলি ব্যবহার করতেন, যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস রাখা হতো।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, যখন পুরুষদের পোশাকে পকেটের নানাবিধ ব্যবহার শুরু হলো, নারীদের পোশাকের নকশায় সেভাবে পকেটের জায়গা হয়নি। বরং, পোশাকের সৌন্দর্য এবং শরীরের গড়ন ফুটিয়ে তোলার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে যখন পুরুষরা পকেটে করে ছুরি, ঘড়ি বা পিস্তল রাখতেন, নারীদের জন্য তৈরি পোশাকগুলিতে পকেট কার্যত অনুপস্থিত ছিল।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে দেখা যায়, নারীদের পোশাকের এই পকেট-বঞ্চনার পেছনে কাজ করেছে পিতৃতন্ত্রের ধারণা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের পোশাককে সাজসজ্জার একটি মাধ্যম হিসেবেই বেশি দেখা হতো, যেখানে ব্যবহারিক দিকের চেয়ে নান্দনিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো।
এমনকি, অষ্টাদশ শতকে যখন কিছু নারী ঘোড়দৌড়ের পোশাকে পকেট ব্যবহার করতে শুরু করেন, তাদের “অ্যামাজন” (গ্রিক পুরাণের নারী যোদ্ধা) হিসেবে চিহ্নিত করা হতো এবং পুরুষালি পোশাকের জন্য সমালোচিত হতে হতো।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে চলা আন্দোলনেও এই পকেটের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নারীবাদী লেখিকা অ্যালিস ডুয়ের মিলার ১৯১৫ সালে ‘আর উইমেন পিপল? আ বুক অফ রাইমস ফর সাফ্রাজ টাইম’ (Are Women People? A Book of Rhymes for Suffrage Time) -এ নারীদের পকেট না থাকার বিষয়টিকে একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন।
তবে, বিংশ শতাব্দীতে নারীদের পোশাকের ধরনে পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে, যুদ্ধকালীন সময়ে নারীরা যখন বিভিন্ন পেশায় যোগ দেন, তখন তাদের কাজের সুবিধার্থে পকেটের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে।
পোশাকের নকশায় আরও আধুনিকতা আসে, এবং কিছু ক্ষেত্রে নারীদের পোশাকে পকেটের ব্যবহারও দেখা যায়।
আজকালকার ফ্যাশন ট্রেন্ডে নারীদের পোশাকের পকেট নিয়ে বিতর্ক এখনো বিদ্যমান। অনেক ডিজাইনার নারীদের পোশাককে আরও আকর্ষণীয় করতে শরীরের গড়ন ফুটিয়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেন, যার ফলে পকেটের স্থান সংকুচিত হয়।
এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, ফ্যাশন শিল্প নারীদের জন্য হ্যান্ডব্যাগ ব্যবহারের ধারণাকে প্রাধান্য দেয়, যে কারণে তারা পোশাকের ডিজাইন করার সময় পকেটের প্রয়োজনীয়তাকে সেভাবে গুরুত্ব দেন না।
ফ্যাশন বিশেষজ্ঞদের মতে, পোশাকের উপযোগিতা নাকি সৌন্দর্য – এই বিতর্কে প্রায়ই সৌন্দর্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে, নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে পকেটের প্রয়োজনীয়তা অনেক সময় উপেক্ষিত হয়।
এই পকেট-বৈষম্য, যা আদতে লিঙ্গবৈষম্যেরই একটি ক্ষুদ্র রূপ, এখনো ফ্যাশন জগতে বিদ্যমান।
তথ্য সূত্র: CNN