নেপালের গহীন অরণ্যে, যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া এখনও তেমন পড়েনি, সেখানেই বাস করে ‘রাউতে’ নামের এক যাযাবর উপজাতি। আধুনিকতার এই যুগেও তারা নিজেদের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে রেখেছে, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
যদিও এই সম্প্রদায়ের মানুষজন এখন চরম সংকটের সম্মুখীন। তাদের জীবনযাত্রা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে, কমছে তাদের জনসংখ্যা।
রাউতে জনগোষ্ঠীর মানুষজন মূলত গিরিখাত অঞ্চলের বনে অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করে। তারা নেপালের আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
যুগ যুগ ধরে তারা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায়। শীতকালে তারা পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসে, আবার গ্রীষ্মে ফিরে যায় পাহাড়ের দিকে।
তাদের জীবনধারণের প্রধান উপায় হলো শিকার করা, বন্য কন্দ ও ফলমূল সংগ্রহ করা, এবং কাঠের তৈরি বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে তা বিনিময় করা। তারা কোনো ধরনের চাষাবাদ বা স্থায়ী বসতি স্থাপন করে না, এমনকি তারা শিক্ষার গুরুত্বও তেমন একটা দেয় না।
নেপাল সরকার রাউতেদের একটি বিপদগ্রস্ত আদিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও সরকারি হিসাব অনুযায়ী, তাদের সংখ্যাটা এখনো উল্লেখ করার মতো, তবে বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন।
২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, তাদের জনসংখ্যা ছিল ৫৬৬। কিন্তু স্থানীয় একটি সংস্থার মতে, বর্তমানে এই সংখ্যাটা ১৩৭-এর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।
এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন, গত কয়েক বছরে এই সম্প্রদায়ের অনেক শিশুর জন্ম হলেও, তাদের মধ্যে অনেকে আবার জন্মের পরই মারা গেছে।
রাউতে সমাজে নারীদের ভূমিকা অনেক বেশি। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে জল সংগ্রহ, খাদ্য জোগাড় করা—সবকিছুই নারীরা করে থাকে।
কিন্তু স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের তেমন কোনো মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। এই সম্প্রদায়ের একজন ২১ বছর বয়সী নারী গাজালি সাহি বলেন, “এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়াটা খুব কঠিন।
নতুন জায়গায় গেলে নতুন করে ঘর তৈরি করতে হয়, রান্নার ব্যবস্থা করতে হয়, জল আনতে হয়। আমাদের জীবনটা সত্যিই খুব কষ্টের।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমি যদি রাউতে সম্প্রদায়ের বাইরে অন্য কোথাও জন্মাতাম, তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো।
রাউতে নারী হিসেবে আমাদের সারাদিন অনেক ভারী কাজ করতে হয়, যা খুবই কষ্টের।”
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গাজালি বলেন, “শিক্ষা আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য ভালো, কিন্তু আমাদের পড়াশোনা করতে দেওয়া হয় না।
বয়স্করা আমাদের পড়াশোনা করতে দিতে রাজি নন, যদিও আমি এবং আমাদের সম্প্রদায়ের অনেক শিশু বিদ্যালয়ে যেতে চাই।
শীতকালে গরম কাপড়ের অভাবে আমাদের অনেক কষ্ট হয়।”
স্থানীয় শিক্ষক লাল বাহাদুর খাত্রি জানিয়েছেন, গোপনে কিছু শিশু বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
তিনি বলেন, “শিশুরা পড়াশোনা করতে খুব আগ্রহী, তাই আমরা গোপনে তাদের নাম লিখতে এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছি।”
রাউতেদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য নেপাল সরকার প্রতি মাসে জনপ্রতি ৪,০০০ নেপালি রুপি (প্রায় ৩,৫০০ বাংলাদেশি টাকা) ভাতা দিয়ে থাকে।
কিন্তু সমাজের বয়স্করা পরিবর্তনের বিরোধী। তাদের ধারণা, আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাদের ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
রাউতে সম্প্রদায়ের নেতা, ৪৯ বছর বয়সী সূর্য নারায়ণ সাহি বলেন, “রাউতে শিশুরা স্কুলে যায় না।
তারা বন্য কন্দ এবং ব্যাঙ খেয়ে অভ্যস্ত। সরকার আমাদের শিশুদের স্কুলে পাঠাতে বলছে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি রাউতেরা এক জায়গায় থাকতে শুরু করে, তাহলে তারা হারিয়ে যাবে। কৃষি আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।”
তবে গাজালির মতে, পরিবর্তন আসবেই, তবে এতে সময় লাগবে।
তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, বয়স্কদের মৃত্যুর পরেই পরিবর্তন আসবে।
তবে কত দিন লাগবে, তা আমি জানি না। আমি যদি সম্প্রদায়ের নেতা হতে পারতাম, তাহলে আমি সব শিশুকে স্কুলে পাঠাতাম।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা