গাজায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন নেতানিয়াহু
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফের সামরিক অভিযান শুরু করেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর পেছনে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে। নেতানিয়াহুর এই সিদ্ধান্তের কারণে তাঁর জোটের কট্টর ডানপন্থী দলগুলো খুশি হয়েছে, কিন্তু ইসরায়েলের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি কয়েক সপ্তাহ ধরে চলার পর, মুক্তি পাওয়া জিম্মিরা তাঁদের বন্দী জীবনের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে শুরু করেন। এর মধ্যেই নেতানিয়াহুকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। একদিকে, তাঁর সরকার টিকিয়ে রাখা চরম ডানপন্থী দলগুলো গাজায় পুনরায় যুদ্ধ শুরুর জন্য চাপ দিচ্ছিল। অন্যদিকে, অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক হামাসের সম্পূর্ণ পরাজয়ের চেয়ে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। জনমত জরিপে দেখা যায়, দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতির পক্ষে ব্যাপক সমর্থন ছিল, যার মধ্যে গাজা থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার এবং জীবিত জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কিন্তু নেতানিয়াহুর অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ শুরু থেকেই যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করে আসছিলেন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ শুরু না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। এই পরিস্থিতিতে, নেতানিয়াহুকে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে ২০২৩ সালের জন্য ইসরায়েলের পার্লামেন্ট, ‘কনেসেট’-এ বাজেট অনুমোদন করাতে হবে, অন্যথায় তাঁর সরকার ভেঙে যাবে এবং দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
গাজার ওপর রাতের বেলা চালানো বোমা হামলা, যা ২০২৩ সালের যুদ্ধের প্রথম দিকের সময়ের চেয়েও ভয়াবহ ছিল, অনেক ইসরায়েলি নাগরিকের কাছে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। হামাসের হাতে এখনো জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা এই পদক্ষেপকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছেন। ইয়োরাম মেটজগার নামের এক জিম্মির স্ত্রী আয়ালা মেটজগার পার্লামেন্টে স্মোটরিচের সঙ্গে বিতর্কে জড়ান।
টাইমস অব ইসরায়েল-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আয়ালা চিৎকার করে বলেন, “টেবিলে এখনো চুক্তি রয়েছে, আর আপনারা আরও জিম্মি ও সৈন্যের জীবন উৎসর্গ করতে চাচ্ছেন।” জবাবে স্মোটরিচ নিরাপত্তা কর্মীদের তাঁকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং বলেন, “আমরাও অনেক মূল্য দিয়েছি। আসুন, এই নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা না করি।”
শুধু বামপন্থী বা হামাসের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোই নয়, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) অ্যামোস ইয়াদলিন বলেন, জিম্মিরা গাজায় থাকাবস্থায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু করা হলে সেখানে সামরিক বাহিনীর কার্যকারিতা কমবে এবং মনোবল ভেঙে যাবে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “একজন দায়িত্বশীল ইসরায়েলি নেতা, যাঁর কোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবেচনা নেই, তিনি যুদ্ধ বন্ধের বিনিময়ে প্রথমেই সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনবেন এবং তারপর হামাসকে নির্মূল করার দ্বিতীয় লক্ষ্যটির দিকে মনোযোগ দেবেন।”
তিনি আরও যোগ করেন, “অক্টোবর ২০২৩-এ যখন ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনারা দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন, তখন তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা। এখন কাউকে তাঁদের বোঝাতে হবে যে, এই স্থল অভিযান জিম্মিদের জীবিত ফিরিয়ে আনবে, মৃত নয়। এটা কঠিন কাজ।”
ইতিমধ্যে সৈন্যদের মধ্যে হতাশা দেখা দিতে শুরু করেছে। হারেৎজ পত্রিকার খবর অনুযায়ী, সরকারে আচরণের প্রতিবাদে রিজার্ভ থেকে একজন যুদ্ধ বিমানের নাবিককে বরখাস্ত করেছে সামরিক বাহিনী। বিমান বাহিনী এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললেও, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন যে, আরও অনেকে এই পথে হাঁটতে পারেন।
৭ অক্টোবরের ঘটনায় নেতানিয়াহুর তদন্ত কমিশন গঠনে অনীহা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, তিনি দেশপ্রেমের চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
তিনি যুদ্ধের শুরু থেকেই বলে আসছেন, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার সেরা উপায় হলো সামরিক চাপ প্রয়োগ করা, যদিও মুক্তি পাওয়াদের বেশিরভাগই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ফিরে এসেছেন। তাঁর মতে, হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করাই ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
নেতানিয়াহুর দপ্তর হামাসের ওপর যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়ার দায় চাপিয়েছে। তাদের ভাষ্য, হামাস জিম্মিদের মুক্তি দিতে বারবার অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল এবং মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। উভয় পক্ষের বারবার লঙ্ঘনের ফলে চুক্তিটি ভেস্তে যায়। ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরুর সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়া হয়। ইয়াদলিন বলেন, এর ফলে ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান দুর্বল হয়েছে।
যাই হোক, যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার রাজনৈতিক সুফল দ্রুত দৃশ্যমান হয়। কট্টর ডানপন্থী নেতা ইতামার বেন-গভির, যিনি যুদ্ধবিরতির কারণে জানুয়ারি মাসে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার সরকারে ফিরে আসেন। তিনি রাতের বেলার হামলাকে “সঠিক নৈতিক, এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপ” হিসেবে বর্ণনা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী গিদোন সার নিশ্চিত করেন যে, এই হামলা বৃহত্তর অভিযানের সূচনা হতে পারে।
গাজার কিছু অংশে ইসরায়েল কর্তৃক এলাকা খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা ইঙ্গিত করে যে, তারা স্থল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও এখনো সৈন্য পাঠানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ইসরায়েলি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, নতুন প্রতিরক্ষা প্রধান ইয়ায়েল জামির দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই গাজায় হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেন।
যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ এবং মানবিক সংস্থাগুলোর মতো ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও গাজায় বসবাস করা ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তুলেছে। তবে সার জানান, ওয়াশিংটনকে হামলার বিষয়ে আগে জানানো হয়েছিল এবং তারা এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের কূটনৈতিক সমর্থক। ডোনাল্ড ট্রাম্প অতীতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, হামাস যদি সব জিম্মিকে মুক্তি না দেয়, তবে “এর ফল ভোগ করতে হবে।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান