তরুণ প্রজন্মের স্বাস্থ্য নিয়ে এক গভীর উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। চিকিৎসা বিষয়ক বিশ্বখ্যাত জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান কিশোর-কিশোরীরা অতীতের যেকোনো প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, অতিরিক্ত ওজনের সমস্যা এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সংকট—এগুলো তাদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় এক বিলিয়নের বেশি কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি একটি প্রধান উদ্বেগের কারণ।
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২১০০ সাল নাগাদ কিশোর-কিশোরীরা শিল্প-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে প্রায় ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা অনুভব করবে, যা তাদের জীবনযাত্রায় চরম আবহাওয়ার প্রভাব ফেলবে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা কমে যাওয়া, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ক্ষতি, সামাজিক অস্থিরতা এবং তাপ-সম্পর্কিত রোগ বেড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো ঘটবে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির সহজলভ্যতাও আরেকটি উদ্বেগের কারণ। বর্তমানে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ এবং উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রায় ৯৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি একদিকে যেমন জ্ঞানার্জনের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, তেমনিভাবে এটি তাদের ভুল তথ্য, সাইবার বুলিং, এবং ক্ষতিকর কনটেন্টের প্রতি সংবেদনশীল করে তুলছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence – AI) দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে এই ঝুঁকিগুলো আরও বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজনের সমস্যাও বাড়ছে, যা একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফ্রিকার কিছু অংশে এবং এশিয়ায় অতিরিক্ত ওজনের হার আটগুণ পর্যন্ত বেড়েছে।
২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রায় ৪৬ কোটি ৪০ লাখ কিশোর-কিশোরী অতিরিক্ত ওজন অথবা স্থূলতার শিকার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে অস্বাস্থ্যকর খাবারের সহজলভ্যতা এবং খেলাধুলা ও ব্যায়ামের সুযোগের অভাবকে দায়ী করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্বেগের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা অথবা আত্মহত্যার কারণে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ সুস্থ জীবনের বছর নষ্ট হবে, যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২০ লাখ বেশি।
ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো দীর্ঘমেয়াদী কারণগুলোর পাশাপাশি কোভিড-১৯ অতিমারির কারণেও তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা, ডিজিটাল প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার প্রচার করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধি করা।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তাদের জন্য খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর খাবারের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
একইসাথে, ডিজিটাল প্রযুক্তির ভালো দিকগুলো কাজে লাগিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক