৬০ বছর বয়সের পর নতুন জীবন: এক ব্যক্তির মানসিক বিপর্যয় ও অশ্রুহীন জীবনের গল্প
জীবনের এক কঠিন বাঁকে এসে মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছিলেন ডেভিড উইলিয়ামস। তাঁর বয়স যখন সতেরো, মা-কে হারান তিনি। গভীর রাতে মায়ের বন্ধু এসে যখন দুঃসংবাদটি শোনান, তখন চোখের জল ফেলেননি ডেভিড।
বাবার অনুপস্থিতিতে তিন বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, সংসারের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। তাই হয়তো ভেতরের কষ্ট চেপে রেখে ছুটেছিলেন জীবিকার সন্ধানে।
৬১ বছর বয়সী ডেভিড বলেন, “তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, নিজের ইচ্ছেরা গুরুত্ব পাওয়ার সুযোগ পায়নি।”
১৯৮০ সালের সেই সময়ে চেশায়ারের লাচে সোশ্যাল হাউজিং এস্টেটে ছিল তাঁদের বসবাস। ডেভিডের ভাষায়, “সেটা ছিল কঠিন একটা জায়গা।
ছেলেরা সহজে কাঁদে না।” অভাব ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ডেভিড, একটি গাড়ির যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তিনি।
মায়ের সঙ্গে কাটানো শেষ মুহূর্তগুলো আজও ডেভিডের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। মা কী বলেছিলেন, আর কী বলতে পারেননি, সেসব যেন তাঁর গভীর আবেগকে একরকম বন্দী করে রেখেছিল।
এরপর কেটে গেছে বহু বছর। ডেভিড কাজের সূত্রে লন্ডন যান, বদলেছেন পেশা। নাইট ক্লাবে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে এবং এক পুত্র সন্তানের জন্ম।
পরবর্তীতে, একটি স্পোর্টস শপ তাঁকে এসেক্স-এ একটি শাখা ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব দেয় এবং বাড়ি কিনতে সাহায্য করে।
এতোকিছুর পরও ডেভিডের চোখে জল আসেনি।
তিনি বলেন, “পুরো প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে আমি কখনো কাঁদিনি। ভেঙে পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না।”
তিরিশের কোঠায় মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করেন ডেভিড। এরপর, চল্লিশে পৌঁছে তিনি এক্সিকিউটিভ কোচিংয়ের উপর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
এর মূল কারণ ছিল, সফল হওয়ার পেছনে তাঁর নিজস্ব তাড়নাগুলো ভালোভাবে বোঝা।
ডেভিড জানান, “মা শিখিয়েছিলেন, জীবন খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। তাই আমি সবসময় সবকিছু পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করতাম…কিন্তু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা সবকিছু এলোমেলো করে দেয়।”
আবাসন সংকটের কারণে এসেক্সের বাড়িতে ফাটল দেখা দেয়। বীমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করার পর, সংসার চালানোর জন্য ডেভিডকে বিদেশে গিয়ে কাজ করতে হয়।
সেখানে তিনি আর্থিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন।
জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে, ২০১৪ সালে, ত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান হয়।
ডেভিড বলেন, “আমি আমার জীবনের ভালোবাসাকে হারিয়েছি”, কিন্তু তখনও তিনি কাঁদেননি।
এরপর এলো আরও কঠিন সময়। যখন তাঁর বয়স ৫৫, ডাক্তার জানালেন তিনি ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত।
ডেভিড বলেন, “তখন লড়াই করার সময়। আমি তো এটাই করতে অভ্যস্ত।” মানসিক বিপর্যয়ের কথা শুনলে অনেকেই ভয় পান।
কিন্তু ডেভিডের মতে, “মানসিক বিপর্যয় হলো পুরোনো ‘আমি’-এর মৃত্যু। আপনার মস্তিষ্ক নিজেকে নতুন করে সাজায়, আপনার যত্ন নেয়।”
টিউমারের কারণে কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। রেডিওথেরাপির কারণে খিঁচুনি হতো, হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে। ডেভিড নিজেকে খুব একা অনুভব করছিলেন।
এর মধ্যেই আসে কোভিড এবং লকডাউন। ডেভিড বলেন, “জীবনে প্রথমবারের মতো আমি নিজের সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাই।”
কিন্তু হয়তো এটাই তাঁর জন্য বেশি হয়ে গিয়েছিল। ৫৯ বছর বয়সে “আত্ম-অনুসন্ধানের এই সময়” তাঁর জীবনে নিয়ে আসে মানসিক বিপর্যয়।
তিনি বলেন, “মানসিক বিপর্যয় হলো পুরোনো ‘আমি’-এর মৃত্যু। আপনার মস্তিষ্ক নিজেকে নতুন করে সাজায়। এটা আপনার যত্ন নিচ্ছে।”
হাসপাতালে যখন তাঁর বোনেরা দেখা করতে আসতেন, ডেভিড কেঁদে বুক ভাসাতেন।
প্রথমবারের মতো তাঁরা মায়ের সম্পর্কে গভীর আলোচনা করেন।
“আমার মনে হয়, তাঁরা সবসময় আমাকে একটু দূরের মানুষ হিসেবে দেখত। আমি তো দূরে চলে গিয়েছিলাম, তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না।” চোখের জল যখন গড়িয়ে পড়ছিল, ডেভিড যেন মুক্তি পাচ্ছিলেন।
তাঁর ভেতরের অনেক কিছুই যেন বেরিয়ে আসছিল।
বর্তমানে ডেভিড মানসিক বিপর্যয় থেকে সেরে উঠছেন এবং টিউমার নিয়েই জীবন কাটাচ্ছেন। নিজের অভিজ্ঞতা লিখে তিনি আত্ম-উন্নয়নের চেষ্টা করছেন।
চার্চে একটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন।
গত বছর, ৬০ বছর বয়সে, তিনি একটি সহায়তা দলের সঙ্গে যুক্ত হন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শোক প্রকাশ করা তাঁর জন্য জরুরি।
তিনি বলেন, “একটা ব্রেইন টিউমার যে কারো জন্য ভালো হতে পারে, তা বলা কঠিন। কিন্তু যদি আমার টিউমার না হতো, তাহলে হয়তো আমি কাজ চালিয়েই যেতাম, আর এই মানসিক বিপর্যয় আসতো না।
টিউমার থাকা সত্ত্বেও, আমি অবশেষে ‘স্বাভাবিক’ হতে শিখছি।”
আজকাল ডেভিড মাঝেমধ্যে তাঁর মা, বিবাহিত জীবন বা সাধারণ জীবন নিয়ে কাঁদেন।
তিনি বলছেন, “যা ঘটেছে, এই বিশাল পরিবর্তন, সেগুলোর অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি এবং কীভাবে আবার নতুন করে শুরু করা যায়, সেই পথ খুঁজছি।”
শোক প্রকাশ করতে শেখা মানে হলো, “এখানে থাকার, ভালোবাসার এবং একটি সুন্দর ছেলে পাওয়ার আনন্দকে উপলব্ধি করা।”
ডেভিড জানেন, জীবন খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়।
“এর মানে হলো, কেউ হয়তো আবার আমাকে ভালোবাসবে, এবং আমি কীসের উপর মনোযোগ দেব, তা বেছে নিতে পারব। আমার এখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।