৬০ বছরে নতুন পথে যাত্রা! ১০,০০০ মাইল দূরে থেকেও ভালোবাসার বাঁধন অটুট

৬০ বছর বয়সের পর নতুন দিগন্ত: স্বামীর থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও ভালোবাসার বাঁধনে।

জীবন সবসময় এক পথে চলে না। কখনও কখনও, জীবনের গতিপথ বদলায়, বাঁক নেয় অপ্রত্যাশিত দিকে। এমনই এক গল্প, যা প্রমাণ করে ভালোবাসার গভীরতা এবং আত্ম-অনুসন্ধানের অদম্য স্পৃহা থাকলে, দূরত্বের ব্যবধানও তুচ্ছ হয়ে যায়।

মার্গারেট মারফি, যিনি জীবনের ষাট বছর পেরিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে, সুপ্রতিষ্ঠিত সংসার, স্বামী এবং চার সন্তান নিয়ে মার্গারেটের জীবন কাটছিল বেশ ভালোই। কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছিল, জীবনের আরও কিছু বাকি আছে। গতানুগতিক জীবন থেকে বেরিয়ে এসে নিজের জন্য কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করছিলেন তিনি।

বিয়ের ত্রিশ বছর পর, যখন সন্তানেরা বড় হয়ে গেছে, নিজেদের মতো জীবন শুরু করেছে, তখন তিনি এক ভিন্ন পথের সন্ধান করেন।

মার্গারেট জানান, তিনি বিশ্বটা দেখতে চেয়েছিলেন, কিছুটা অ্যাডভেঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। তাই ৫৬ বছর বয়সে একাই পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে, যেখানে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত।

এরপর ৬০ বছর বয়সে, জীবনের প্রথম পূর্ণকালীন চাকরি শুরু করেন, এবং নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষা কর্মকর্তা, সার্জনদের পেশাগত উন্নয়নে সহায়তা করতেন।

আজ মার্গারেটের বয়স ৭১। তিনি এবং তাঁর স্বামী পিটার, এখনো বিবাহিত জীবন অতিবাহিত করছেন, যদিও তাঁরা এখন দুটি ভিন্ন মহাদেশে থাকেন। মার্গারেটের মতে, “এটি একটি আধুনিক, উদার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন বিবাহিত জীবন। যেখানে বয়স্ক দম্পতিরা তাঁদের সাংসারিক দায়িত্বগুলি ভাগ করে নিয়ে, নিজেদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারে।”

২০১০ সালে যখন মার্গারেট প্রথম লন্ডনে যান, তখন তিনি পিটারকে বলেছিলেন, ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে ফিরে আসবেন। কিন্তু নতুন দেশে থিতু হতে তাঁর বেশি সময় লেগেছিল। প্রথমে কাজ খুঁজে পেতে সমস্যা হয়েছিল, মাঝে মাঝে বেকারও ছিলেন।

এভাবে একটি বছর, দুটি বছর করে কেটে যায়। মার্গারেট বলেন, “এখানে অনেক ভালো কিছু হয়েছে।”

নতুন চাকরি, নতুন বন্ধু—এসবের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মানুষের জীবন সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। পিটারও মাঝে মাঝে তাঁর কাছে যান, এবং তাঁরা নিউ ইয়র্ক কিংবা নয়া দিল্লিতে মিলিত হয়ে ছুটি কাটান।

মার্গারেটের লন্ডনের ছোট ফ্ল্যাটটি কুইন্সল্যান্ডের বিশাল বাড়ির থেকে একেবারেই আলাদা। কিন্তু কাজ শেষে যখন তিনি নিজের সোফায় বসেন, বাজার করা বা বিল পরিশোধ করার পর, আত্মনির্ভরতার গভীর অনুভূতি তাঁকে শান্তি দেয়।

মার্গারেট বলেন, “আমি যখন এখানে এসেছিলাম, মনে হয়েছিল এবার আমার পালা। মা মারা যাওয়ার পর, যেন নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন হলো। আমি নিজের দেখাশোনা করতে পারতাম।”

মার্গারেটের শৈশব কেটেছে ব্রিসবেনে। তাঁর ভাইবোনদের মধ্যে দু’জনের জীবন ছিল দুর্বিষহ অসুস্থতায় ভরা। মার্গারেট এবং তাঁর মা তাঁদের দেখাশোনা করতেন। এই কঠিন সময়ে প্যারিসে তাঁর মায়ের সঙ্গে কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল, যা তাঁর জীবনে এনেছিল ভিন্ন স্বাদ।

২৫ বছর বয়সে এক পার্টিতে তাঁর সঙ্গে পিটার এর দেখা হয়। পরের বছর তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর শিশুদের জন্ম হয়। যখন সন্তানেরা ছোট ছিল, তখন তিনি শিক্ষকতা করতেন। সন্তানদের আগমনে তাঁর জীবনে আনন্দের ঢেউ লেগেছিল, প্রতিদিন নতুন কিছু ঘটত।

তবে, জীবনের এই পর্যায়ে এসে মার্গারেট অনুভব করেন, তাঁর আরও কিছু করার আছে। তিনি পড়াশোনা শুরু করেন, এবং অবশেষে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

মার্গারেট জানেন, তিনি ব্রিসবেনে ফিরবেন—কারণ তাঁর বাড়িটা এখনও তাঁর কাছে প্রিয়। তবে কবে ফিরবেন, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।

অনেকে তাঁর এই সিদ্ধান্তকে হয়তো স্বার্থপর মনে করেন। তিনি বলেন, “আমি দ্বিধা বোধ করি—একজন স্ত্রী হিসেবে কর্তব্য পালন করব, নাকি নিজের ইচ্ছে মতো জীবন কাটাব?”

তবে তিনি মনে করেন, যা করেছেন, তা তাঁর জন্য ফলপ্রসূ হয়েছে। “দম্পতি হিসেবে আপনারা অন্যভাবেও ভাবতে পারেন। বয়স্ক মহিলারাও কর্মজীবনে সফল হতে পারেন।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমি শিখেছি কীভাবে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়, এবং সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, আমি একাই জীবন কাটাতে শিখেছি। অন্য মানুষের প্রতি আরও সহনশীল হয়েছি।”

মার্গারেট এবং পিটার একে অপরের সিদ্ধান্তকে সম্মান করেন, এবং তাঁদের জগৎ আরও প্রসারিত হয়েছে। তাঁদের এই সম্পর্ক প্রমাণ করে, ভালোবাসার গভীরতা থাকলে, দূরত্ব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *