১৯৭৭ সালের গ্রীষ্মকালে, নিউ ইয়র্ক শহর যেন এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল। বিদ্যুতের বিভ্রাট—যা মূলত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চালন লাইনে বজ্রপাতের কারণে ঘটেছিল—শহরজুড়ে ব্যাপক লুটতরাজ, দাঙ্গা এবং অগ্নিকাণ্ডের জন্ম দেয়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, ফায়ার ডিপার্টমেন্টকে শুধুমাত্র এক রাতেই হারলেম, ব্রুকলিন এবং সাউথ ব্রঙ্কসে অগ্নিকাণ্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিল, যা প্রতিদিনের গড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার থেকে কয়েকগুণ বেশি ছিল। এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, শহরটি বুঝি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
কিন্তু এই সংকট থেকে নিউ ইয়র্ককে বাঁচিয়েছিল কোনো বিশাল আর্থিক সাহায্য বা বড় ধরনের সংস্কার নয়। বরং, শহরের টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি ছিল একটি সাধারণ নকশা—যা তৈরি করেছিলেন ডিজাইনার মিল্টন গ্লেজার, একটি হলুদ ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে। তাঁর তৈরি করা ‘আই লাভ নিউ ইয়র্ক’ লোগোটি (I ❤️ NY) দ্রুতই শহরের মানুষের কাছে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে, যা একসময় নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা শহরবাসীর মনে নতুন করে আশার আলো জাগিয়েছিল। ডিজাইন বিশেষজ্ঞ এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রাক্তন আর্ট ডিরেক্টর স্টিভেন হেলার এই লোগোর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, “প্রয়োজন এবং তাৎপর্যের এক অসাধারণ সম্মিলন ঘটেছিল।”
আসলে, ১৯৭০-এর দশকে নিউ ইয়র্কের এই খারাপ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। প্রথমে, কারখানাগুলো বন্ধ হতে শুরু করে, যার ফলস্বরূপ মাত্র ছয় বছরে প্রায় তিন লক্ষ মানুষের চাকরি চলে যায়। এরপর, ধনী বাসিন্দারা শহর ছেড়ে শহরতলিতে চলে যেতে শুরু করে, সঙ্গে নিয়ে যায় তাদের করের টাকা। ফলে, শহরের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য ঋণ করতে হয়।
এরপরে আসে বাজেট কাটছাঁটের পালা। শিক্ষক থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী—সবার চাকরি যেতে শুরু করে। শহরের রাস্তায় ময়লার স্তূপ জমে ওঠে। এমনকি, ফায়ার ডিপার্টমেন্টও বন্ধ করার উপক্রম হয়, কারণ তাদের রক্ষণাবেক্ষণের মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। সারাহ লরেন্স কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘সাউন্ডস্কেপস নিউ ইয়র্ক’ (Soundscapes NYC) পডকাস্টের নির্মাতা রায়ান পার্সেল বলেছিলেন, “তখন এমনও পরিস্থিতি হয়েছিল যে, কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কোন এলাকাগুলোতে তারা পরিষেবা বন্ধ করে দেবে।”
শহরে অপরাধের হার বেড়ে যায়, প্রতি বছর এক হাজারের বেশি মানুষ খুন হতো। এমনকী, অগ্নিসংযোগও একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল। পার্সেল আরও বলেন, “বাড়ির মালিকরা বীমার টাকা পাওয়ার জন্য তাদের নিজস্ব ভবনগুলোতে আগুন লাগাতেন। কারণ, এতে তাদের ভাড়ার থেকে বেশি লাভ হতো।”
সাউথ ব্রঙ্কসের কিছু অংশে, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৭ শতাংশ। কর্মকর্তারা একে ‘পরিকল্পিত সংকোচন’ (Planned Shrinkage) নামে অভিহিত করেন, যা ছিল দরিদ্র এলাকাগুলো থেকে পরিষেবা প্রত্যাহার করে সেখানকার জনসংখ্যা কমানোর বিতর্কিত এক নগর পরিকল্পনা।
১৯৭৫ সাল নাগাদ, ম্যানহাটনে প্রবেশের প্রতিটি পথে—গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল, পেন স্টেশন, পোর্ট অথরিটি—পুলিশ পর্যটকদের হাতে ‘ওয়েলকাম টু ফিয়ার সিটি’ (Welcome to Fear City) শিরোনামের একটি লিফলেট ধরিয়ে দিত, যেখানে তাদের শহর ত্যাগ করার জন্য সতর্ক করা হতো। সাবওয়েগুলোতে গ্রাফিতি আঁকা হতো এবং প্রায়ই সেগুলো বিকল হয়ে যেত।
যখন শহরটি সাহায্যের জন্য ওয়াশিংটনের কাছে আবেদন জানায়, তখন ‘ডেইলি নিউজ’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের বিখ্যাত মন্তব্যটি প্রকাশিত হয়: ‘ফোর্ড টু সিটি: ড্রপ ডেড’। হেলার বলেন, “যদি ‘আই লাভ নিউ ইয়র্ক’ ধারণাটি এমন একটা সময়ে আসত, যখন কেউ নিউ ইয়র্ককে বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, তাহলে হয়তো এটি কাজ করত না। কিন্তু মানুষ নিউ ইয়র্ককে ভালোবাসত এবং শহরটিকে আরও সুন্দর দেখতে চেয়েছিল।”
১৯৭৭ সালের গ্রীষ্মকাল আরও বেশি বিভীষিকা নিয়ে আসে। ‘সন অফ স্যাম’ সিরিয়াল কিলার পত্রিকার মাধ্যমে শহরবাসীকে ভীতি দেখাচ্ছিল। প্রচন্ড গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পাওয়ার গ্রিড তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। ১৩ জুলাই, রাত ৮টা ৩৭ মিনিটে ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টিতে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বজ্রপাত হয়। আর এর মাধ্যমেই পুরো নিউ ইয়র্ক অন্ধকারে ডুবে যায়।
পরের ২৫ ঘণ্টা যেন এক বিভীষিকা বয়ে আনে। এক হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, ১,৬০০টি দোকানে লুটপাট হয় এবং প্রায় ৩,৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। ‘টাইম’ ম্যাগাজিন এটিকে ‘নাইট অফ টেরর’ (The Night of Terror) হিসেবে অভিহিত করে। বাইরের পর্যবেক্ষকরা নিউ ইয়র্ককে ‘নতুন পতনের পথে যাওয়া রোম’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
এই ব্ল্যাকআউটের ফলে শহরের মানুষের মধ্যে নতুন করে উপলব্ধি জন্মায়: শহরের শুধু বেশি পুলিশ বা পরিচ্ছন্ন রাস্তার প্রয়োজন ছিল না, বরং প্রয়োজন ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর একটি গল্প, যা মানুষকে পুনরায় নিউ ইয়র্কের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে সাহায্য করবে।
এই চরম সংকটকালে, নিউ ইয়র্কের বাণিজ্য বিভাগ বিজ্ঞাপন সংস্থা ওয়েলস রিচ গ্রিনের (Wells Rich Greene) ওপর একটি অসম্ভব কাজের দায়িত্ব দেয়। পার্সেল বলেন, “তারা এই ভয়ের পরিবেশ থেকে শহরটিকে পুনরায় ব্র্যান্ডিং করার চেষ্টা করছিল।” আর এর ফলস্বরূপ যা তৈরি হয়েছিল, তা ডিজাইন ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
এই প্রচারণার শুরুটা হয়েছিল তিনটি সাধারণ শব্দ দিয়ে: ‘আই লাভ নিউ ইয়র্ক’ (I Love New York)। রাজ্যের বাণিজ্য বিভাগের ডেপুটি কমিশনার উইলিয়াম এস. ডয়েল, স্থানীয় নিউ ইয়র্কবাসী মিল্টন গ্লেজারকে এই ভিজ্যুয়াল পরিচয় তৈরির জন্য অনুরোধ করেন। যদিও এটি প্রাথমিকভাবে রাজ্যের পর্যটন প্রচারণার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, তবে লোগোটি দ্রুতই শহরের আত্মার প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করে।
গ্লেজার ততদিনে ডিজাইন জগতে একজন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি ‘নিউ ইয়র্ক’ ম্যাগাজিনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, সাইকেডেলিক বব ডিলান পোস্টারের কারিগর ছিলেন এবং বাণিজ্যিক কাজের ক্ষেত্রে ফাইন-আর্টের ধারণা এনেছিলেন। এই কাজের জন্য তিনি ২,০০০ ডলার সম্মানী পেয়েছিলেন, কিন্তু গ্লেজার কখনোই সেই চেক ভাঙেননি।
গ্লেজারের প্রথম প্রচেষ্টা ছিল খুবই সাধারণ, যেখানে কোনো প্রতীক ছিল না এবং পরিচ্ছন্ন টাইপোগ্রাফি ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে, ট্যাক্সিতে চড়ার সময় তাঁর মাথায় আসে আসল ধারণা। ট্যাক্সি যখন রাস্তার গর্তের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি পকেট থেকে একটি লাল পেন্সিল বের করে একটি খামের পেছনে আঁকতে শুরু করেন: উপরে ‘আই’ (I), মাঝে একটি লাল হৃদ চিহ্ন (❤️), এবং নিচে ‘এনওয়াই’ (NY)। তিনি ‘লাভ’ (Love) শব্দটির পরিবর্তে একটি সর্বজনীন প্রতীক ব্যবহার করেন। এই ধারণাটি এসেছিল গাছের কাণ্ডে প্রেমিকের নাম খোদাই করার ধারণা থেকে।
হেলার বলেন, “এটি ছিল একটি ভিজ্যুয়াল কৌতুক। তিনি এমন কিছু ব্যবহার করেছিলেন যা এতটাই সাধারণ ছিল যে, তা প্রায় অদৃশ্য—যেমন মানুষ তাদের বর্ষপুঞ্জি এবং শুভেচ্ছা কার্ডে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ লিখে থাকে—এবং এটিকে নিউ ইয়র্কের প্রতি ভালোবাসার ধারণার সঙ্গে যুক্ত করেছেন।” হৃদ চিহ্নটি যেন সমস্ত আবেগ ধারণ করে ছিল।
এই নকশাকে অসাধারণ করে তুলেছিল এর বক্তব্য নয়, বরং অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা। হতাশার মুহূর্তে, এটি বিরল কিছু উপস্থাপন করেছিল: আশা।
শুরুতে, নিউ ইয়র্কের মানুষজন এই প্রচারণার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে। পার্সেল বলেন, “যখন প্রথম এই স্লোগানটি আসে, তখন ‘সন অফ স্যাম’ তখনও মানুষ মারছিল। কিন্তু যখন এটি সরকারি প্রকাশনা এবং পর্যটন সামগ্রীতে স্থান পায়, তখন মানুষ এর মধ্যে পরিবর্তন দেখতে শুরু করে।” ১৯৭৮ সাল নাগাদ, হোটেলের ব্যবসার উন্নতি হয় এবং পর্যটনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
এই ডিজাইনের শক্তি ছিল এর সঠিক সময়ে আগমন। পার্সেল বলেন, “এই লোগো নিউ ইয়র্কবাসীকে তাদের শহরের প্রতি গর্ব দেখানোর অনুমতি দিয়েছিল, যা তারা আগে অনুভব করতে পারছিল না।” একবার এটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর, এটি শুধু বিজ্ঞাপন ছিল না, বরং প্রতিরোধের একটি কাজ ছিল—একটি নীরব ঘোষণা যে, তাদের শহর এখনও ভালোবাসার যোগ্য।
গ্লেজার এই ডিজাইনটি রাজ্যের কাছে উপহার হিসেবে দেন এবং নিজে কখনো এর স্বত্ব নেননি। ২০১১ সাল নাগাদ, এই লোগো নিউ ইয়র্কের জন্য বছরে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করে।
এই লোগোটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সংকটে নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে। ৯/১১-এর ঘটনার পর, ম্যানহাটনের পোস্টারগুলোতে লেখা ছিল ‘আই ❤️ NY মোর দ্যান এভার’ (I ❤️ NY More Than Ever), যেখানে হৃদ চিহ্নের বাম পাশে একটি ছোট কালো দাগ ছিল, যা শহরের ক্ষতচিহ্নকে প্রকাশ করত। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়, ডিজাইনটি আবার ফিরে আসে, সামান্য পরিবর্তিত হলেও আগের মতোই সহজে চেনা যাচ্ছিল।
হেলার বলেন, “মিল্টন জানতেন যে, এই লোগোটির তাৎপর্য রয়েছে এবং এটি যে কেউ দেখবে, তাদের সবার কাছেই এর আবেদন থাকবে। রবার্ট ইন্ডিয়ানার ‘লাভ’ (LOVE) ভাস্কর্যের মতো, এটির নিজস্ব জীবন ছিল।”
লোগোটি মানুষের মনে দাগ কেটেছিল, কারণ এটি কেবল শহরের নতুন ব্র্যান্ডিং করেনি, বরং নিউ ইয়র্কবাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, বিপর্যয়ের মধ্যেও ভালোবাসা একটি শক্তিশালী প্রতিরোধের হাতিয়ার হতে পারে। হেলার বলেন, এই বার্তাটি “কখনোই হারাবে না।”
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক