হাসপাতাল ঠান্ডা, স্বাস্থ্যও সুরক্ষিত: পরিবেশ রক্ষার এক নতুন গল্প!

শিরোনাম: কার্বন নিঃসরণ কমাতে যুক্তরাজ্যের হাসপাতাল: বাংলাদেশের জন্য কি কোনো শিক্ষা আছে?

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আজ বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, তেমনি দূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যহানিও ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে, উন্নত দেশগুলো তাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস), যা দেশের স্বাস্থ্যখাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাদের কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাইছে।

ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামে অবস্থিত কুইন’স মেডিকেল সেন্টার (কিউএমসি)-এ সম্প্রতি একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালটির পুরনো জানালাগুলো পরিবর্তন করে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে নতুন ডাবল-গ্লেজড জানালা।

এই পদক্ষেপটি হাসপাতালের শক্তি সাশ্রয়ী করার একটি অংশ, যার মাধ্যমে ২০৪০ সালের মধ্যে হাসপাতালটিকে কার্বন নিরপেক্ষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিউএমসি’র এস্টেট বিভাগের প্রধান, মাইক সোরোকা জানান, “আগে হাসপাতালের ভেতরের পরিবেশ ঠান্ডা ও শব্দপূর্ণ ছিল। নতুন জানালা লাগানোর ফলে শীতকালে গরম এবং গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা অনুভূত হয়, যা রোগীদের জন্য খুবই উপকারী।”

বস্তুত, শক্তি সাশ্রয় এবং সুস্বাস্থ্য একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হওয়া বায়ু দূষণ হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অ্যাজমার মতো রোগের কারণ।

এনএইচএস একদিকে যেমন এসব রোগের চিকিৎসা করে, তেমনি এটি কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রেও একটি বড় উৎস। জানা যায়, ইংল্যান্ডে এনএইচএস-এর কার্বন নিঃসরণ মোট কার্বন Footprint-এর প্রায় ৪%।

পুরনো ভবন এবং অতিরিক্ত খরচের চাপ এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

এই সমস্যা সমাধানে সরকার এনএইচএসকে ২০৪০ সালের মধ্যে সরাসরি কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার একটি আইনগত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

কিউএমসি’র সঙ্গে কাজ করছে ই.ও.এন (E.ON) সহ আরও অনেক সংস্থা, যারা হাসপাতালের শক্তি সাশ্রয়ী করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

জানালা পরিবর্তনের পাশাপাশি, ই.ও.এন-এর সঙ্গে ১৫ বছরের একটি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে একটি নতুন এনার্জি সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। এই কেন্দ্রে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার না করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হিট পাম্প ব্যবহার করা হবে, যা বাতাস এবং ভূগর্ভ থেকে তাপ শোষণ করে হাসপাতালের গরম ও শীতলীকরণ ব্যবস্থা সচল রাখবে।

নতুন এই পদ্ধতির ফলে বছরে ১০,০০০ টন কার্বন নিঃসরণ কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা রাস্তা থেকে ২,২০০ টির বেশি গাড়ি সরানোর সমতুল্য। একইসঙ্গে এটি হাসপাতালের পরিচালন খরচ কমিয়ে রোগীদের জন্য আরও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করবে।

স্বাস্থ্যখাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর এই উদ্যোগ শুধু পরিবেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও জরুরি। অতিরিক্ত ঠান্ডায় বসবাস করা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে, যা আর্থ্রাইটিস এবং অ্যাজমার মতো দীর্ঘমেয়াদী রোগকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জ্বালানি দারিদ্র্যের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়।

এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে জ্বালানি কোম্পানিগুলো গত এক দশকে প্রায় ২০ লক্ষ বাড়িতে শক্তি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি প্রকল্প হলো “হোমস ফর লিভিং” উদ্যোগ। এই প্রকল্পের অধীনে বয়স্ক মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য বিভিন্ন সহায়ক ব্যবস্থা ও বাড়ির সংস্কার করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, এর ফলে অংশগ্রহণকারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ই.ও.এন-এর হিসাব অনুযায়ী, এই প্রকল্প যদি সারা ইংল্যান্ডে আরও বড় আকারে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে ১.৭ বিলিয়ন পাউন্ড সাশ্রয় করা সম্ভব।

যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপগুলো থেকে বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছু শেখার আছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। এখানে বায়ু দূষণ একটি বড় সমস্যা এবং এর কারণে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটছে।

বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতেও শক্তি সাশ্রয়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো এবং পুরনো পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়ক হবে।

একইসঙ্গে, দরিদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নত আবাসনের ব্যবস্থা করা গেলে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সম্ভব।

সুতরাং, যুক্তরাজ্যের এনএইচএস-এর এই উদ্যোগ শুধু তাদের দেশের জন্য নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সুস্থ ও পরিবেশবান্ধব স্বাস্থ্যখাত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *