নাইজেরিয়ার অনেক নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করে তাদের আদি আফ্রিকান বিশ্বাসে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এই পরিবর্তনের কারণ, তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বিদ্যমান সমাজের চিত্র তুলে ধরে একটি নতুন চিত্র তৈরি হয়েছে।
আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ নাইজেরিয়া, যেখানে প্রায় ২০ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। এখানে খ্রিস্ট ধর্ম প্রধান ধর্ম হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। অনেক ধর্মগুরু ও পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, যা তাদের আদি সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের দিকে আকৃষ্ট করছে।
উদাহরণস্বরূপ, চিডি নওয়াওহিয়া নামের এক ব্যক্তির কথা বলা যায়। শৈশব থেকেই তিনি খ্রিস্ট ধর্ম এবং আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মধ্যে আসা-যাওয়া করেছেন। তার জীবনের নানা ঘটনার মাধ্যমে তিনি অনুভব করেছেন, হয়তো তার পথ ভিন্ন।
তিনি জানান, ডিবিয়া (পুরোহিত ও ঔষধ বিক্রেতা) তাকে বলেছিলেন, তিনি তার দাদার পুনর্জন্ম, যিনি ছিলেন ইগবো সম্প্রদায়ের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক।
এই ধরনের বিশ্বাস পশ্চিম আফ্রিকার সংস্কৃতিতে নতুন নয়। তবে নওয়াওহিয়ার মা, যিনি গভীর খ্রিস্টান ছিলেন, এই ভবিষ্যদ্বাণীতে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং ছেলেকে সে কথা জানাননি। নওয়াওহিয়া যখন ১৭ বছর বয়সে বাপ্তিস্ম নিলেন, তখন এক দুর্ঘটনায় আহত হন। তিনি মনে করেন, সম্ভবত তিনি ভুল পথে ছিলেন।
আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। তিনি জানান, যারা তাদের আসল পথ খুঁজে নেয়, তারা উন্নতি করে, আর যারা পথ হারায়, তারা ফিরে আসা পর্যন্ত নানা সমস্যায় পরে। ১৯৯৩ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ডিবিয়া হিসেবে অভিষিক্ত হন, যেখানে প্রার্থনা, শুদ্ধিকরণ ও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এই পরিবর্তনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিতৃষ্ণা তৈরি হওয়া। তারা অভিযোগ করেন, অনেক যাজক আধ্যাত্মিকতার চেয়ে বস্তুগত বিষয়গুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেন, যা বাইবেলের শিক্ষার পরিপন্থী।
এই পরিবর্তনের পেছনে আরও একটি কারণ হলো, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতি মানুষের গভীর আকর্ষণ। উপনিবেশিক শাসনের আগে নাইজেরিয়ার মানুষেরা তাদের পূর্বপুরুষ, প্রকৃতি এবং সম্প্রদায়ের দেব-দেবীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখত।
তবে যারা খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করে তাদের আদি বিশ্বাসে ফিরে আসছেন, তাদের অনেককে পরিবার ও সমাজের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নওয়াওহিয়ার মা প্রথম দিকে তার ছেলের এই সিদ্ধান্তে খুশি ছিলেন না। কারণ, এটি ছিল তার বিশ্বাসের প্রতি এক ধরনের আঘাত।
ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাসে ফিরে আসা ব্যক্তিরা সামাজিক বৈষম্যের শিকার হন। তাদের ‘পৌত্তলিক’, ‘শয়তানের উপাসক’ বা ‘ডাইনি’ ইত্যাদি আখ্যা দেওয়া হয়। অনেক সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের সন্দেহের চোখে দেখে।
এই ধরনের মনোভাবের পেছনে মিশনারিদের প্রভাব রয়েছে, যারা স্থানীয় বিশ্বাসকে পশ্চাৎপদ ও বিপদজনক হিসেবে চিত্রিত করেছেন।
তবে, যারা আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী ধর্মানুসারী, তারা বিশ্বাস করেন, সব ধর্মের ঈশ্বরের ধারণা তাদের মধ্যেই বিদ্যমান। তারা খ্রিস্টান ও ঐতিহ্যবাহী উভয় রীতি-নীতি পালন করেন।
ইচেজোনা ওবিয়াগবাওসোগু নামের এক ব্যক্তি, যিনি আগে ক্যাথলিক পুরোহিত ছিলেন, বর্তমানে খ্রিস্ট ও ঐতিহ্যবাহী উভয় ধর্ম পালন করেন। তিনি এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যিনি একইসঙ্গে নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান এবং বৃষ্টি প্রস্তুতকারক ছিলেন।
এই পরিবর্তনের পেছনে আরও একটি কারণ হলো, সহজে ধনী হওয়ার বাসনা। অনেকে মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী দেব-দেবীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলে আর্থিক উন্নতি ও অলৌকিক ক্ষমতা পাওয়া যায়। তবে, কেউ কেউ মনে করেন, খ্রিস্টান চার্চগুলোর সম্পদ-কেন্দ্রিকতা তাদের বিতৃষ্ণা তৈরি করেছে।
ঐতিহ্যবাহী ধর্মানুসারীরা মনে করেন, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি ও পৃথিবীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মতে, হত্যা, ব্যভিচার ও অবিচার—এগুলো শুধু মানুষের প্রতি অপরাধ নয়, প্রকৃতিরও ক্ষতিসাধন করে।
তবে, এই পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। নতুন অনুসারীদের জন্য এখানে কোনো গাইড বা পথপ্রদর্শক নেই। ফলে, অনেক সময় তারা দ্বিধায় পরে যান। তাছাড়াও, এই ধর্মের কিছু আচার-অনুষ্ঠান গোপনীয় হওয়ায়, এর শিক্ষা ও ধারণাগুলো ভালোভাবে বোঝা কঠিন।
খ্রিস্টান চার্চগুলোও এই পরিবর্তনের বিষয়টি উপলব্ধি করছে। তারা তাদের অনুসারীদের ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু চার্চ কৃষিকাজে সহায়তা করছে এবং প্রশিক্ষণ ও অনুদান প্রদান করছে।
ঐতিহাসিক চিজিওকে এনগোবিলি মনে করেন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আদি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, যা খ্রিস্ট ধর্মের আধিপত্যের জন্য হুমকি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, কিছু লোক ঐতিহ্যবাহী ধর্মকে ব্যবহার করে অর্থ ও ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করে, যা এই ধর্মের ভাবমূর্তিকে কলুষিত করে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা