কান্নার বদলে ইশারায় চলে প্রার্থনা! আফ্রিকার এই চার্চে ঈশ্বরের দেখা পান বধিররা

**নাইজেরিয়ার একটি বিশেষ গির্জা: যেখানে বধির মানুষেরা খুঁজে পায় আশ্রয় ও ঈশ্বরের সান্নিধ্য**

বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনযাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে থাকে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এবং সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বাধা বিদ্যমান।

নাইজেরিয়ার বৃহত্তম শহর লাগোসে এমনই এক ব্যতিক্রমী গির্জা রয়েছে, যেখানে বধির সম্প্রদায়ের মানুষেরা একত্রিত হয়ে নিজেদের জন্য একটি আশ্রয় খুঁজে পান। সম্প্রতি সেখানকার ‘ক্রিশ্চিয়ান মিশন ফর দ্য ডেফ’ নামক গির্জার কার্যক্রম পরিদর্শন করে জানা যায়, এটি শুধু একটি উপাসনালয়ই নয়, বরং বধির মানুষদের জন্য একটি ভালোবাসার স্থানও বটে।

**বধিরদের জন্য একটি বিশেষ জগৎ**

সাধারণত, অন্যান্য গির্জার মতো এই গির্জায়ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এর পরিবেশ খানিকটা ভিন্ন।

এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শুধু হাতের ইশারায় চলে আসা কথোপকথন আর ড্রামের শব্দ শোনা যায়। প্রার্থনার সময়, হাঁটু গেড়ে বসার সময় কিংবা যাজকের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য এই শব্দগুলোই সংকেত হিসেবে কাজ করে।

প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন সদস্য এই গির্জায় একত্রিত হন।

এই গির্জার অন্যতম প্রধান যাজক, ইমাম উদোকা। তিনি নিজেও একজন বধির ব্যক্তি।

মেনিনজাইটিস (meningitis) রোগে আক্রান্ত হয়ে ছোট বয়সে তিনি শ্রবণশক্তি হারান। এরপর তিনি সমাজের মূলধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

কিন্তু এই গির্জায় আসার পর তিনি নতুন জীবন খুঁজে পান। তিনি জানান, এখানে তারা নিজেদের ভাষায়, অর্থাৎ ইশারা ভাষায় ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারেন।

যাজক রেমি আকিনরেনমি-এর মতে, এই গির্জা বধির সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য একটি আশ্রয়স্থল। আগে তাদের কোনো আশ্রয় ছিল না, কিন্তু এখন তারা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হন এবং নিজেদের মধ্যে একটি সম্প্রদায় তৈরি করেছেন।

তিনি বলেন, ঈশ্বর সব ভাষাই বোঝেন, তাই ইশারা ভাষার মাধ্যমেও তারা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করেন।

**সমাজের চোখে প্রতিবন্ধকতা এবং একটি নতুন দিগন্ত**

বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন গির্জাগুলো আফ্রিকার দেশগুলোতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় ভিন্ন হয়ে থাকে।

অনেক ক্ষেত্রে, এই ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে ঐশ্বরিক অভিশাপ হিসেবেও দেখা হয়। এই গির্জাগুলো তাদের জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি করে, যেখানে তারা নিজেদের মতো করে বাঁচতে পারে এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

এই গির্জায় শুধু ধর্ম বিষয়ক আলোচনা হয় না, এখানে ইশারা ভাষা শেখানোরও ব্যবস্থা রয়েছে।

রেমি আকিনরেনমি জানান, এই ভাষা শেখার মাধ্যমে বাইরের জগৎ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা যায়। এমনকি গির্জার সদস্যদের শ্রবণক্ষমতাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরাও এখানে আসে, যাতে তারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে পারে।

১৯৫৬ সালে ‘ক্রিশ্চিয়ান মিশন ফর ডেফ আফ্রিকানস’ হিসেবে এই গির্জার যাত্রা শুরু হয়েছিল।

বর্তমানে, নাইজেরিয়ায় প্রায় ১ কোটি মানুষ শ্রবণ প্রতিবন্ধী অথবা শ্রবণ সমস্যা নিয়ে বসবাস করেন।

**বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য সুযোগের অভাব**

বাংলাদেশেও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তাদের জন্য সুযোগ তৈরি হলেও, তা এখনো যথেষ্ট নয়। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও অনেক সময় তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাব দেখা যায়।

এই প্রেক্ষাপটে, নাইজেরিয়ার এই গির্জার কার্যক্রম একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

এটি প্রমাণ করে, কিভাবে একটি বিশেষ স্থান শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য আশ্রয়স্থল হতে পারে এবং তাদের সামাজিক জীবনকে উন্নত করতে পারে।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *