আলো ঝলমলে নক্ষত্রের শক্তি! ফিউশন প্ল্যান্টে বিদ্যুতের যুগ?

যুক্তরাষ্ট্রে পরমাণু ফিউশন প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎপাদনের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বোস্টনের কাছে একটি কারখানায় নক্ষত্রের শক্তিকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন।

তাদের লক্ষ্য হল এমন একটি মেশিন তৈরি করা, যা একইসঙ্গে সৌরজগতের সবচেয়ে উষ্ণ এবং শীতল স্থান হবে। এই প্রকল্পের সাফল্য পেলে আগামী এক দশকের মধ্যে আমেরিকায় কার্যত সীমাহীন এবং দূষণমুক্ত বিদ্যুতের উৎপাদন সম্ভব হবে।

পরমাণু ফিউশন প্রক্রিয়াটি সূর্যের শক্তি উৎপাদনের মতোই। এই প্রক্রিয়ায় পরমাণুগুলোকে একত্রিত করে বিপুল পরিমাণ শক্তি তৈরি করা হয়। এটি বর্তমানে প্রচলিত পারমাণবিক বিদ্যুতের (নিউক্লিয়ার ফিশন) সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে পরমাণুগুলোকে ভেঙে শক্তি উৎপাদন করা হয়।

ফিউশন পদ্ধতিতে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের কোনো সমস্যা নেই, যা একে অনেক বেশি নিরাপদ করে তোলে।

“কমনওয়েলথ ফিউশন সিস্টেমস” (Commonwealth Fusion Systems) নামক একটি সংস্থা এই প্রকল্পের প্রধান উদ্যোক্তা। তারা “স্পার্ক” (SPARC) নামের একটি টোকামাক বানাচ্ছে, যা কয়লা বা প্রাকৃতিক গ্যাসের চেয়ে ১০ মিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম হবে এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান তৈরি করবে না।

এই ফিউশন প্রক্রিয়ার মূল উপাদান হল ডিউটেরিয়াম, যা সমুদ্রের পানিতে পাওয়া যায় এবং ট্রিটিয়াম, যা লিথিয়াম থেকে সংগ্রহ করা হয়।

তবে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল এমন একটি শক্তিশালী এবং নির্ভুল মেশিন তৈরি করা, যা উত্তপ্ত প্লাজমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে এবং উৎপাদিত শক্তির চেয়ে বেশি শক্তি সরবরাহ করতে পারবে। এই লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছে।

ফিউশন ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু হল্যান্ডের মতে, বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে তারা খুব দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।

ইতিমধ্যেই, এই প্রকল্পে ২ বিলিয়নের বেশি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে তারা প্রত্যাশা করছেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা প্রয়োজনীয় শক্তির চেয়ে বেশি উৎপাদন করতে পারবে এবং ২০৩০ সালের শুরুতে ভার্জিনিয়াতে বিশ্বের প্রথম ফিউশন পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করতে সক্ষম হবে।

সংস্থার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ব্র্যান্ডন সোরবম বলেন, “আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করছি এবং একই সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (AI) মতো নতুন প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে চেষ্টা করছি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা চীনের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, কারণ চীনও ফিউশন প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রগতি লাভ করছে। এমন পরিস্থিতিতে, ভার্জিনিয়ার গভর্নর গ্লেন ইয়ংকিং বলেছেন, “চীন ফিউশন প্ল্যান্ট তৈরি করছে, তাই আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এই প্রতিযোগিতা চলছে।

ফিউশন বিজ্ঞান মূলত স্থিতিশীল। মূল সমস্যা হল, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ধরে এই বিক্রিয়াটি বজায় রাখা। টোকামাকের ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী চুম্বক তৈরি করছেন, যা প্লাজমাকে ধারণ করে রাখতে সক্ষম।

প্লাজমা হল অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং হালকা একটি গ্যাস, যা ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য অপরিহার্য। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেরি নাভরাটিলের মতে, “প্লাজমা খুবই অস্থির, তাই একে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন।

স্পার্ক প্রকল্পের নকশা করা হয়েছে, যাতে চুম্বক ব্যবহার করে প্লাজমাকে শীতল এবং স্থিতিশীল রাখা যায়। প্লাজমা ঠান্ডা হলে দৃশ্যমান হয়। প্লাজমার হালকা প্রকৃতির কারণে ফিউশন প্রক্রিয়াটি খুবই নিরাপদ।

যদি কোনো কারণে বিক্রিয়া বন্ধ করতে চান, তবে এটি খুব সহজেই করা সম্ভব। ব্র্যান্ডন সোরবম আরও বলেন, “যদি কোনো উল্কাপাত হয় এবং ভ্যাকুয়াম ভেসেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যাবে।

এখানে ফুকুশিমা বা চেরনোবিলের মতো কোনো বিপর্যয় ঘটবে না।

স্পার্ক আকারের দিক থেকে প্রচলিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চেয়ে অনেক ছোট। এর ফলে ভবিষ্যতে এটিকে বিদ্যমান বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে স্থাপন করা সহজ হবে। যদিও এর উচ্চতা ৩০ ফুটের বেশি হবে, এটি ফ্রান্সের “আইটিইআর” (ITER) -এর চেয়ে অনেক ছোট, যা ২২ তলা ভবনের সমান।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পাশাপাশি, ফিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রিটিয়াম তৈরির জন্য লিথিয়াম ভাণ্ডারের সরবরাহ নিশ্চিত করাটাও জরুরি। মার্কিন জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তার মতে, চীন ইতিমধ্যেই এই ক্ষেত্রে বেশ সক্রিয়তা দেখাচ্ছে।

ফিউশন প্রযুক্তির মাধ্যমে “পরবর্তী সভ্যতার” সূচনা করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কমনওয়েলথ ফিউশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বব মামগার্ডের মতে, ফিউশন প্রযুক্তি তেল ও গ্যাসের স্থান পূরণ করতে পারে। তিনি আরও বলেন, এই প্রযুক্তি সকলের জন্য আরও বেশি শক্তি সরবরাহ করতে পারবে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *