ওমেগা-৩: উপকারী ফ্যাট, সাপ্লিমেন্ট কি নিরাপদ?

ওমেগা-৩: স্বাস্থ্যকর হৃদয়ের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান, কিন্তু সাপ্লিমেন্ট কি সবসময় উপকারী?

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে এর জুড়ি নেই। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং শরীরের প্রদাহ কমাতে ওমেগা-৩ এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের অনেকের খাদ্যতালিকায় এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির অভাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ৬৮ শতাংশ পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা-৩ গ্রহণ করে না।

তাই অনেকেই খাদ্যতালিকায় এই ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাব পূরণের জন্য মাছের তেল বা ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্টের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বজুড়ে ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্টের বাজার এখন প্রায় ৮.৩ বিলিয়ন ডলারের।

তবে, ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট সবার জন্য উপকারী নাও হতে পারে। কিছু বিশেষ স্বাস্থ্য condition যেমন হৃদরোগের ক্ষেত্রে এটি সহায়ক হতে পারে, কিন্তু সুস্থ মানুষের জন্য এর উপকারিতা এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত নয়।

বরং, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মাছের তেল বা ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট সেবনের কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে।

ওমেগা-৩ আসলে কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মূলত দুই প্রকার: ইকোসাপেন্টাইনোয়িক অ্যাসিড (EPA) এবং ডকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড (DHA)। এই দুটি উপাদান প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং শরীরের বিভিন্ন কার্যকারিতা সঠিক রাখতে সহায়তা করে।

এটি রক্তের খারাপ ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায় এবং কোষের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করে।

ডা: ড্যানিয়েল মন্টি, যিনি টমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটির সিডনি কিমেল মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক, ব্যাখ্যা করেন, “ওমেগা-৩ রক্ত প্রবাহকে উন্নত করে এবং কোষের শক্তি উৎপাদনকারী অঙ্গাণু, মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যকারিতা বাড়ায়।”

ওমেগা-৩ এর প্রাকৃতিক উৎস

শরীরে ওমেগা-৩ এর চাহিদা পূরণের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো খাদ্য গ্রহণ। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, যেমন – ইলিশ, টুনা, সার্ডিন, ম্যাকারেল, এবং আরও অন্যান্য তেলযুক্ত মাছ ওমেগা-৩ এর ভালো উৎস।

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (American Heart Association) এর মতে, প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুইবার (প্রতিবার প্রায় ৮৫-১০০ গ্রাম) এই ধরনের মাছ খাওয়া উচিত।

তবে, মাছ ছাড়াও কিছু উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবারেও ওমেগা-৩ পাওয়া যায়।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ন্যাশনাল জিউইশ হেলথের কার্ডিওভাসকুলার প্রিভেনশন অ্যান্ড ওয়েলনেস বিভাগের পরিচালক অ্যান্ড্রু ফ্রিম্যান বলেন, “মাছ আসলে শৈবাল (algae) খেয়ে এই তেল সংগ্রহ করে।”

তাই, শৈবাল, বাদাম, সয়াবিন, তিসি বীজ, চিয়া বীজ এবং শণ বীজের মতো খাবার থেকেও ওমেগা-৩ পাওয়া যেতে পারে।

এছাড়াও, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিম এবং কিছু দুগ্ধজাত পণ্যেও এই উপাদানটি থাকে। ক্যানোলা এবং সয়াবিন তেলে আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (ALA) পাওয়া যায়, যা এক ধরনের ওমেগা-৩।

সাপ্লিমেন্টের পরিবর্তে খাবার গ্রহণ করা ভালো

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক এবং ব্রিগহ্যাম অ্যান্ড উইমেন্স হাসপাতালের প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের প্রধান জোঅ্যান ম্যানসন বলেন, “খাবার থেকে ওমেগা-৩ গ্রহণ করাই সবচেয়ে ভালো।

কারণ, খাবারে এই ফ্যাটি অ্যাসিডের সঙ্গে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানও পাওয়া যায়।”

কেন সাপ্লিমেন্ট সবসময় উপকারী নয়?

মাছের তেলের সাপ্লিমেন্টের চেয়ে তাজা মাছ খেলে শরীরে ওমেগা-৩ এর উপকারিতা বেশি পাওয়া যায়।

কারণ, খাবারে EPA, DHA এবং ALA এর প্রাকৃতিক রূপ বিদ্যমান থাকে। ডা: মন্টি আরও বলেন, “সাপ্লিমেন্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় পুষ্টির গুণগত মান কমে যেতে পারে এবং এতে ক্ষতিকর উপাদান মেশারও সম্ভবনা থাকে।”

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট হৃদরোগের জন্য উপকারী, এমন দাবির পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।

ফ্রিম্যান বলেন, “কিছু প্রাথমিক গবেষণায় হৃদরোগের উন্নতিতে মাছের তেলের ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেলেও, পরবর্তীকালে সেই তথ্যগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছে।”

সাপ্লিমেন্ট কেনার আগে সতর্কতা

মাছের তেলের অনেক বোতলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর দাবি করা হলেও, সেই দাবির পক্ষে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।

টেক্সাসের ইউটি সাউথওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টারের কার্ডিওলজিস্ট, অ্যান মেরি নাভার-এর মতে, “এই ধরনের দাবি মূলত পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণার উপর ভিত্তি করে করা হয়।

তাই, সাপ্লিমেন্ট সেবনের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।”

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা হৃদরোগে আক্রান্ত নন, তাদের মাছের তেল সেবনের ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৫ শতাংশ এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (atrial fibrillation) এর ঝুঁকি ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) কর্তৃক সেভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না, যেমনটা খাবার বা ওষুধের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

এর ফলে নিম্নমানের সাপ্লিমেন্টেও ভেজাল তেল বা ক্ষতিকর ভারী ধাতু থাকতে পারে। অতিরিক্ত মাছের তেল সেবনে রক্ত জমাট বাঁধা কমে যাওয়া, হজমের সমস্যা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে।

এছাড়াও, মাছের তেল বাতাসের সংস্পর্শে এলে জারিত (oxidize) হয়ে যায়, যা শরীরের কোষের ক্ষতি করতে পারে।

জার্নাল অফ ডায়েটারি সাপ্লিমেন্টস (Journal of Dietary Supplements) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জনপ্রিয় মাছের তেলের ব্র্যান্ডগুলোর প্রায় ৪৫ শতাংশে পচন ধরেছিল।

সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে করণীয়

কিছু বিশেষ স্বাস্থ্য condition যেমন হৃদরোগ থাকলে, মাছের তেল সাপ্লিমেন্ট উপকারী হতে পারে।

সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রেসক্রিপশনযুক্ত সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত।

ওভার-দ্য-কাউন্টার (ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কেনা) সাপ্লিমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখতে পারেন।

যেমন, সাপ্লিমেন্টটি কোনো স্বীকৃত সংস্থা থেকে পরীক্ষিত কিনা, তা দেখে নিন।

সাপ্লিমেন্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে কিনা, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

ডা: মন্টি বলেন, “ওমেগা-৩ স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি খাদ্য থেকে গ্রহণ করাই ভালো।

সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের প্রয়োজন হলে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।”

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *