আমাদের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন কোনো সুস্পষ্ট যুক্তিবোধ বা বিশ্লেষণের সুযোগ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নতুন চাকরি গ্রহণ করা থেকে শুরু করে সংকটকালীন মুহূর্তে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া—এসব ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই আমাদের অন্তর্জ্ঞানের ওপর নির্ভর করি।
অন্তর্দৃষ্টি, বা ইনটিউশন (Intuition), হল এমন এক ক্ষমতা যা আমাদের কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই জ্ঞান অর্জন করতে বা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
বহুদিন ধরে, অন্তর্দৃষ্টিকে প্রায়শই এক রহস্যময় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অনেকের মতে, এটি ভালো বা খারাপ উভয় দিকেই প্রভাবিত করতে পারে, তবে এর কার্যকারিতা পরিমাপ করা কঠিন। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন এবং এর একটি সুস্পষ্ট সংজ্ঞা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং ‘দ্য ইনটিউশন টুলকিট’ (The Intuition Toolkit) বইটির লেখক জোয়েল পিয়ারসন (Joel Pearson) বলেন, “আমার মতে, অন্তর্দৃষ্টি হল আমাদের অবচেতন মনের তথ্যের একটি শিক্ষণীয় এবং উৎপাদনশীল ব্যবহার, যা আমাদের ভালো সিদ্ধান্ত নিতে বা কাজ করতে সাহায্য করে।” পিয়ারসনের মতে, কিছু ক্ষেত্রে, অবচেতন তথ্য আমাদের ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, আবার কখনও কখনও পক্ষপাতদুষ্টতা বা বায়াস (Bias)-এর মতো বিষয়গুলো আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করে। এই দুটির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে, অন্তর্দৃষ্টির সুবিধাগুলো কী? পিয়ারসন ব্যাখ্যা করেন, সব সময় অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করা সম্ভব নয়, তবে এমন কিছু পরিস্থিতি আছে যেখানে এটি আমাদের সাহায্য করতে পারে।
যেমন, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলে এবং তথ্য অস্পষ্ট থাকলে অন্তর্দৃষ্টি কাজে আসে। আইসল্যান্ডের শিল্পী হ্রুন্দ গানস্টেইনসডত্তির (Hrund Gunnsteinsdóttir) তাঁর ‘ইনসাই’ (InnSæi) বইটিতে অন্তর্দৃষ্টিকে ‘একটি মূর্ত জ্ঞান’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এর অর্থ হল, এটি প্রায়শই আমাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া দ্বারা চালিত হয়, যেমন—অস্বস্তি বা সঠিক বোধের অনুভূতি। এই অনুভূতিগুলো খুব সূক্ষ্ম হতে পারে এবং আমাদের পরিবেশের সংকেত বা আগে দেখা তথ্যের ধরন দ্বারা গঠিত হয়।
বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাপ্লাইড সায়েন্সের অধ্যাপক ফ্লোরিয়ান আর্টিংগার (Florian Artinger) বলেন, “অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ সিদ্ধান্ত কৌশলগুলো খুবই শক্তিশালী হতে পারে, কারণ এগুলো সরাসরি সঠিক তথ্যের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।” ব্যবসার জগতে আর্টিংগার প্রায়ই দুটি উপায়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেখেন—হয় কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী একজন ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে, অথবা ব্যাপক এবং সময়সাপেক্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
দুটি কৌশলই বৈধ হতে পারে, তবে সঠিক পরিস্থিতিতে, একটি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া যেতে পারে, কম সম্পদ ব্যবহার করে এবং এমনকি সেরা ফলাফলও দিতে পারে। আর্টিংগার আরও বলেন, “আপনার যদি অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে আপনার অন্তর্দৃষ্টি একটি খুব ভালো সমাধান দিতে পারে।”
নতুন বাজারে প্রবেশ করা বা গ্রাহকের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে কোনো পণ্য পরিবর্তন করার মতো ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলোতে এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সীমিত তথ্য থাকে।
কিন্তু, সব সময় কি অন্তর্দৃষ্টি সঠিক? পিয়ারসনের গবেষণা দেখাচ্ছে যে, এমন কিছু পরিস্থিতি আছে যেখানে অবচেতন তথ্যের ব্যবহার আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
তিনি এই অবস্থাকে ‘ভুল অন্তর্দৃষ্টি’ (Misintuition) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, পিয়ারসন দেখেছেন যে আমাদের অন্তর্দৃষ্টির নির্ভুলতা আমাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
তীব্র আবেগ, যেমন উদ্বেগ বা অতিরিক্ত আনন্দ, প্রায়শই সূক্ষ্ম সংকেতগুলোকে প্রভাবিত করে যা আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে পরিচালিত করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি হাঙরের ভয় পান, তবে সেই ভয়টি পরিসংখ্যানগতভাবে হাঙরের আক্রমণের বিরলতার প্রমাণকে ছাপিয়ে যেতে পারে।
নটিংহ্যাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক ডারেল কুকসন (Darel Cookson) বলেন, ভুল অন্তর্দৃষ্টির আরেকটি বড় উদাহরণ হল, অন্তর্দৃষ্টির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতি বিশ্বাস।
তাঁর মতে, আমাদের চিন্তাভাবনার দুটি ধরন রয়েছে: একটি বিশ্লেষণাত্মক এবং অন্যটি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা ধীর, কিন্তু বেশি নির্ভুল। অন্যদিকে, অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ চিন্তাভাবনা দ্রুত, তবে জ্ঞানীয় পক্ষপাতদুষ্টতার (Cognitive biases) সম্ভাবনা বেশি।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ক্ষেত্রে, “কখনও কখনও কিছু পড়া এবং দ্রুত সিদ্ধান্তে আসা, তথ্য সম্পর্কে আরও সমালোচনামূলক বা বিশ্লেষণাত্মকভাবে চিন্তা করার চেয়ে সহজ।”
অন্তর্দৃষ্টির দুর্বলতা হলো, যখন একজন ব্যক্তি তাঁর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র থেকে বাইরে যান। উদাহরণস্বরূপ, স্টিভ জবস (Steve Jobs) প্রায়শই ব্যবসা এবং প্রযুক্তি জগতে সাফল্যের জন্য অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করতেন, কিন্তু অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন, যা কিছু বিশেষজ্ঞের মতে তাঁর অকাল মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
তাহলে, কীভাবে আমরা আমাদের অন্তর্দৃষ্টির ব্যবহার আরও ভালো করতে পারি? পিয়ারসন এই বিষয়ে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম তৈরি করেছেন, যা ‘স্মাইল’ (SMILE) নামক একটি সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়েছে:
- স্ব-সচেতনতা (Self-awareness): নিজের আবেগ এবং শারীরিক অবস্থার প্রতি সচেতন থাকুন। উদ্বেগ বা আনন্দের মতো শক্তিশালী আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হলে অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন।
- দক্ষতা (Mastery): শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রগুলোতে অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করুন যেখানে আপনার জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে।
- প্রবৃত্তি ও আবেগ (Instincts and impulses): মনে রাখতে হবে, অন্তর্দৃষ্টি আমাদের প্রবৃত্তি এবং আবেগের মতো নয়। প্রবৃত্তি হল জন্মগত আচরণ, যেমন—উচ্চতা দেখলে ভয় পাওয়া বা খারাপ গন্ধে বিতৃষ্ণা। আবেগ আমাদের আসক্তির প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে এবং আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে প্রভাবিত করতে পারে।
- কম সম্ভাবনার ঘটনা (Low-probability events): বিমান দুর্ঘটনায় পড়া বা লটারি জেতার মতো কম সম্ভাবনার ঘটনার ক্ষেত্রে অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করা উচিত নয়। মানুষ সাধারণত এই ধরনের ঘটনার সম্ভাবনা বুঝতে দুর্বল।
- পরিবেশ (Environment): একটি পরিচিত পরিবেশ অন্তর্দৃষ্টিকে শাণিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের অন্তর্দৃষ্টি প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে তৈরি হয়, যেমন—আমাদের কর্মক্ষেত্র বা বাড়ি। অন্য কোনো পরিবেশে গেলে, সেই অবচেতন অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করা কঠিন হতে পারে।
ডারেল কুকসন আরও উল্লেখ করেন যে, আপনি বিশ্লেষণাত্মক এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ উভয় ধরনের চিন্তাভাবনা একসাথে ব্যবহার করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি একটি জটিল সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করার জন্য বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা ব্যবহার করতে পারেন, এর পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আপনার অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে পারেন। আপনার অন্তর্দৃষ্টির সীমাবদ্ধতাগুলো বোঝা এবং বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনার সাথে এর সমন্বয় করে, আপনি আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক