গ্রহাণু আবিষ্কার: ওর্ট মেঘের অজানা রহস্য উন্মোচন, হতবাক বিজ্ঞানীরা!

মহাকাশে নতুন দিগন্ত: সৌরজগতের রহস্যময় ‘ওর্ট মেঘ’-এ কি লুকানো স্পাইরাল?

মহাবিশ্বের গভীরতা বরাবর আমাদের সৌরজগতের গঠন সম্পর্কে নতুন ধারণা দিতে পারে এমন একটি অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার সম্প্রতি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সৌরজগতের একেবারে বাইরের প্রান্তে অবস্থিত, বরফের জমাট বাঁধা বিশাল এলাকা ‘ওর্ট মেঘ’-এর গঠন সম্ভবত আমরা যা ভাবতাম, তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।

ধারণা করা হতো, এটি একটি গোলাকার এলাকা, কিন্তু নতুন তথ্য বলছে, এটির মধ্যে একটি স্পাইরাল বা সর্পিলাকার গঠন থাকতে পারে।

এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারের সূত্রপাত হয় নিউইয়র্ক শহরের ‘হায়ডেন প্ল্যানেটরিয়াম’-এ একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পর্বে। ‘এনকাউন্টারস ইন দ্য মিল্কিওয়ে’ নামের এই শোটির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময়, বিজ্ঞানীরা যখন সৌরজগতের বাইরের প্রান্ত থেকে আসা তথ্যগুলো পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন তারা ওর্ট মেঘের মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখতে পান।

তাদের পর্যবেক্ষণে ধরা পরে, মেঘের মধ্যে একটি সর্পিলাকার গঠন বিদ্যমান।

এই দৃশ্য দেখে বিজ্ঞানীরা প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরির একজন জ্যোতির্পদার্থবিদ এবং এই শো-এর কিউরেটর জ্যাকি ফাহার্তি জানান, দৃশ্যটি দেখে তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি এটি কোনো ত্রুটি নাকি বাস্তব কোনো চিত্র।

পরে তিনি কলোরাডোর সাউথওয়েস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ডেভিড নেসভরনির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি এই দৃশ্যের বৈজ্ঞানিক তথ্য সরবরাহ করেছিলেন। ডেভিড নেসভরনি নিজেই এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।

নেসভোরনি প্রথমে তথ্যগুলোতে কোনো ভুল আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখেন। কিন্তু সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি নিশ্চিত হন যে, তথ্যে কোনো ভুল নেই এবং ওর্ট মেঘের মধ্যে সত্যিই একটি স্পাইরাল বিদ্যমান।

এরপর তিনি তাঁর এই আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ।

ওর্ট মেঘ আসলে কী? ডাচ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জান ওর্ট ১৯৫০ সালে প্রথম এই মেঘের ধারণা দেন। তাঁর মতে, এটি বরফের তৈরি বিশাল এক এলাকা, যা সূর্যের চারপাশে ১.৫ আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত।

নাসা’র তথ্য অনুযায়ী, এটি আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের এলাকা। এখানে সৌরজগতের সৃষ্টি হওয়ার সময় বিভিন্ন গ্রহাণু এবং বরফের টুকরা চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই কারণেই ওর্ট মেঘকে একটি গোলাকার এলাকা হিসেবে মনে করা হয়।

এই মেঘের মধ্যে থাকা বরফের খণ্ডগুলো যদি সূর্যের দিকে ছুটে আসে, তাহলে তাদের চারপাশে থাকা বরফ বাষ্পীভূত হতে শুরু করে, যা আমরা ধূমকেতু হিসেবে দেখি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধূমকেতুগুলো অত্যন্ত দীর্ঘ পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং তাদের গতিপথ বিশ্লেষণ করে ওর্ট মেঘের গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু ওর্ট মেঘের গঠন পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ, এর উপাদানগুলো আকারে খুবই ছোট এবং অনেক দূরে অবস্থান করে।

এমনকি শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করেও এদের সরাসরি দেখা কঠিন।

স্পাইরাল আবিষ্কারের পেছনে ডেভিড নেসভরনির একটি বিশেষ কৌশল কাজ করেছে। তিনি আগে কখনও এই ডেটা ত্রিমাত্রিকভাবে দেখেননি।

কিন্তু যখন তিনি কার্তেসীয় স্থানাঙ্কে ডেটাগুলো পরীক্ষা করেন, তখন স্পাইরালটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নেসভরনি পরে নাসার ‘প্লিওডিস সুপারকম্পিউটার’-এর মাধ্যমে এই মডেলটির সত্যতা যাচাই করেন। তাঁর সমস্ত সিমুলেশন, যা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলেছিল, একই ফলাফল দেখায় – ওর্ট মেঘের মধ্যে স্পাইরাল বিদ্যমান।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, ওর্ট মেঘের ভেতরের অংশে, অর্থাৎ আমাদের কাছাকাছি অঞ্চলে, এই স্পাইরাল গঠিত হয়েছে।

এর কারণ হলো, এখানকার বস্তুগুলো সূর্যের আকর্ষণ থেকে দূরে থাকার কারণে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মহাকর্ষীয় টানের (Galactic Tide) প্রভাবে প্রভাবিত হয়।

এই আকর্ষণই তাদের কক্ষপথকে বাঁকিয়ে স্পাইরালের আকার দেয়।

তবে, এই আবিষ্কার নিশ্চিত করার জন্য আরও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন।

চিলিতে অবস্থিত ভেরা সি. রুবিন মানমন্দির (Vera C. Rubin Observatory) হয়তো এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।

এই মানমন্দির ওর্ট মেঘের কিছু বস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম হতে পারে, তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্পাইরালের সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বস্তু খুঁজে পাওয়া এখনো কঠিন।

এই আবিষ্কার সৌরজগতের বিবর্তন এবং প্রাণের উপাদান সম্পর্কে নতুন ধারণা দিতে পারে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধূমকেতু সম্ভবত পৃথিবীতে জল সরবরাহ করতে সাহায্য করেছে।

তাই, সৌরজগতের এই অঞ্চলের গঠন বোঝা ভবিষ্যতে জীবনের উৎস অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বর্তমানে, এই আবিষ্কারটি মূলত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল।

তবে, বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে আরও পর্যবেক্ষণ এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এই ধারণার সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব হবে।

মহাকাশ গবেষণার এই নতুন দিগন্ত উন্মোচন নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানীদের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ এবং একই সঙ্গে কৌতূহলের বিষয়।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *