দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কী হয়েছিল? গোপন মিশনে নাৎসি বিজ্ঞানীদের আমেরিকায় আনা হয়!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি: কিভাবে নাৎসি বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ কর্মসূচিতে অবদান রেখেছিলেন

১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই, নীল আর্মস্ট্রং এবং তাঁর সহযাত্রীরা চাঁদে প্রথমবার পা রাখেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনার পেছনে ছিল হাজারো মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা।

কিন্তু অনেকেরই অজানা, এই মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এমন কিছু বিজ্ঞানী, যাদের অতীত ছিল বিতর্কিত। তারা ছিলেন একসময়ের নাৎসি পার্টির সদস্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর, যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’ নামে একটি গোপন কর্মসূচির মাধ্যমে জার্মানির সেরা বিজ্ঞানীদের নিজেদের দেশে নিয়ে আসে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে সামরিক ও মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও শক্তিশালী করা।

কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পেছনে লুকিয়ে ছিল গভীর এক রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকট।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময়, মিত্রশক্তিগুলো জার্মানির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানীদের নিজেদের কব্জায় আনার জন্য উঠেপড়ে লাগে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল, জার্মান বিজ্ঞানীদের সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলো নিজেদের দিকে টানতে পারে।

তাই, তাদের হাতছাড়া হওয়ার আগেই, জার্মানির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়।

এই প্রকল্পের নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’। এর কারণ ছিল, বাছাই করা বিজ্ঞানীদের ফাইলগুলোর উপরে একটি করে পেপারক্লিপ লাগানো হতো। এই ক্লিপের মাধ্যমে বোঝানো হতো, এই বিজ্ঞানীর অতীত জীবন ভালোভাবে যাচাই করার প্রয়োজন নেই।

কারণ, তাদের অনেকেই ছিলেন নাৎসি পার্টির সদস্য বা এসএস-এর মতো কুখ্যাত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১,৫০০ জন জার্মান ও অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানীকে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওয়ার্নার ফন ব্রাউন। তিনি ছিলেন ভি-২ রকেট-এর নির্মাতা এবং একসময় নাৎসি এসএস-এর সদস্য ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর, তিনি মার্কিন সামরিক বাহিনী এবং পরবর্তীতে নাসার হয়ে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেন। তাঁর নেতৃত্বেই তৈরি হয় বিখ্যাত স্যাটার্ন ভি রকেট, যা অ্যাপোলো মিশনে চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।

তবে, অপারেশন পেপারক্লিপ নিয়ে বিতর্ক আজও বিদ্যমান। কারণ, এই প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক নাৎসিকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, যাদের যুদ্ধকালীন ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁদের অতীত জীবন ভালোভাবে যাচাই করা হয়নি।

এই সিদ্ধান্তের ফলে, একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছিল, তেমনিভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষ, বিশেষ করে হলোকাস্টের শিকার হওয়া ইহুদিরা, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।

এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কার্ট ডেবুস, যিনি পরে কেনেডি স্পেস সেন্টারের প্রথম পরিচালক হন এবং হাবের্তাস স্ট্রুঘোল্ড, যিনি মহাকাশ medicine-এর গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্ট্রুঘোল্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি যুদ্ধবন্দীদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন।

অপারেশন পেপারক্লিপ-এর মাধ্যমে আসা অনেক বিজ্ঞানীর অতীত জীবন নিয়ে পরবর্তীতে প্রশ্ন ওঠে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জর্জ রিকহে। তিনি একটি আন্ডারগ্রাউন্ড অস্ত্র কারখানায় শ্রমিক সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাঁকে জার্মানে ফেরত পাঠানো হলেও, পরে তিনি বেকসুর খালাস পান। আর্থার রুডলফ ছিলেন রিকহের সহযোগী এবং স্যাটার্ন ভি রকেটের নির্মাণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

ইতিহাসবিদরা আজও এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারেননি যে, অপারেশন পেপারক্লিপ-এর বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ কর্মসূচিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কয়েক বছরের অগ্রগতি হয়েছিল, তবে এই বিজ্ঞানীদের অবদান নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে।

অপারেশন পেপারক্লিপ শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতির গল্প নয়, এটি একইসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা, নৈতিকতা এবং ইতিহাসের এক জটিল অধ্যায়। প্রশ্ন হলো, বিজ্ঞান কি সবসময় রাজনীতির ঊর্ধ্বে?

কোনো বিজ্ঞানীর যদি বিতর্কিত আদর্শের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকে, তবে কি তাঁর কাজকে সমর্থন করা যায়? এই প্রোগ্রামটি সেই কঠিন প্রশ্নগুলোর জন্ম দেয়, যা আজও আমাদের ভাবায়।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *