এক সময়ের ‘বোরিং’ কোম্পানি, ওরাকল, কিভাবে আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে?
সত্তর দশকের শেষের দিকে ল্যারি এলিসন এবং আরও দুজন কম্পিউটার প্রোগ্রামারের হাত ধরে শুরু হয়েছিল ওরাকলের পথ চলা। প্রথমে, একটি ডাটাবেস প্রোগ্রাম তৈরির জন্য সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)-র কাছ থেকে তারা একটি চুক্তি পায়। সেই প্রোগ্রামের নাম ছিল ‘ওরাকল’। সময়ের সাথে সাথে এটিই কোম্পানিটির পরিচিতি হয়ে ওঠে।
প্রায় ৫০ বছর পর, ডাটাবেস এবং এন্টারপ্রাইজ সফটওয়্যার জায়ান্ট ওরাকল আবারও আলোচনার শীর্ষে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোয়ারে তারা এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবসার মাধ্যমে এআই অ্যাপ্লিকেশনগুলির জন্য প্রয়োজনীয় বিশাল কম্পিউটিং ক্ষমতার চাহিদা মেটাতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ওরাকলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্বগুলির মধ্যে একটি হল ওপেনএআই (OpenAI)-এর সাথে। জানা গেছে, ওপেনএআই ডেটা সেন্টার স্পেসের জন্য ওরাকলকে পাঁচ বছরে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে রাজি হয়েছে।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত ওরাকলের আয়ের প্রতিবেদনে ক্লাউড ব্যবসার অভাবনীয় উন্নতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা শেয়ার বাজারে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। এই বছরের শুরু থেকে ওরাকলের শেয়ারের দাম ৮০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এই বৃদ্ধি এনভিডিয়া, গুগল, মেটা এবং মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি, এই সাফল্যের ফলে কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার ল্যারি এলিসন অল্প সময়ের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিও হয়েছিলেন।
এনভিডিয়া-র মতো, যারা একসময় গেমিং প্রসেসর প্রস্তুতকারক হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাও এআই-এর যুগে নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছে। ওরাকলের এই উত্থান সেই ধারারই একটি উদাহরণ। বিশ্লেষকদের মতে, ওরাকলের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যখন তাদের এআই চিপ ব্যবসা গেমিং ব্যবসাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম টিকটকের (TikTok) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম কোনো মার্কিন কোম্পানির হাতে হস্তান্তরের আলোচনা চললে, সেখানেও ওরাকলের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে টিকটকের মার্কিন কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহীদের মধ্যে ওরাকল অন্যতম। এর আগে, ২০২০ সাল থেকে ওরাকল টিকটকের মার্কিন ডেটা হোস্ট করছে। টিকটকের নিয়ন্ত্রণ পেলে, ওরাকল বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এই অ্যাপ এবং এর মাধ্যমে আমেরিকার ১৭০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর কাছ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ ভালো পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারবে।
ক্লাউড কম্পিউটিং-এর বাজারে ওরাকল তুলনামূলকভাবে দেরিতে প্রবেশ করলেও, এখন তারা গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস, গুগল ক্লাউড এবং মাইক্রোসফট অ্যাজারের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তারা এখন প্রতিযোগিতা করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৩ সালে চ্যাটজিপিটি (ChatGPT) উন্মোচন হওয়ার পর এআই কোম্পানিগুলো তাদের বৃহৎ ভাষার মডেল তৈরি করতে বিপুল পরিমাণ কম্পিউটিং পাওয়ারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সেই সময় ওরাকল তাদের ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবসার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এনভিডিয়ার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে, ওরাকল সহজে এআই চিপগুলো পেতে শুরু করে, যা তাদের ডেটা সেন্টার ব্যবসার জন্য অপরিহার্য ছিল।
ওরাকলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সাফ্রা ক্যাজ-এর মতে, ২০২৬ অর্থবছরে কোম্পানির ক্লাউড অবকাঠামো থেকে আয় ৭৭ শতাংশ বেড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। ২০৩০ সাল নাগাদ এই আয় ১৪৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে, কোম্পানির ‘অবশিষ্ট পারফরম্যান্স বাধ্যবাধকতা’ (Remaining Performance Obligations – RPOs), অর্থাৎ ভবিষ্যতে আদায়যোগ্য চুক্তিবদ্ধ রাজস্ব, বছরে ৩৫৯ শতাংশ বেড়ে ৪৫৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ক্যাজ জানিয়েছেন, কোম্পানিটি গত প্রান্তিকে তিনটি ভিন্ন গ্রাহকের সঙ্গে কয়েক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে।
তবে, ওরাকলকে তাদের আগ্রাসী প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে, এআই কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত কম্পিউটিং পাওয়ারের জন্য অর্থ ব্যয় করতে উৎসাহিত করতে হবে। কিছু বিশ্লেষক এই বিনিয়োগেরReturn নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। যদি এআই-এর চাহিদা প্রত্যাশা অনুযায়ী না বাড়ে, তাহলে ওরাকলকে অন্যান্য বৃহৎ ক্লাউড সরবরাহকারীদের তুলনায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
এআই খাতে ওরাকলের এই সাফল্যের পেছনে তাদের শক্তিশালী ডাটাবেস এবং সফটওয়্যার ব্যবসার অবদান রয়েছে। এই দুটি বিভাগ থেকে তাদের আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে। এছাড়া, ডেটা সেন্টার এবং অবকাঠামো পরিষেবা (infrastructure as a service) খাতে সাফল্য তাদের জন্য বাড়তি সুবিধা নিয়ে আসবে।
ওরাকল সম্প্রতি এআই অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগের জন্য একটি ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উদ্যোগে যোগ দিয়েছে, যার নাম ‘স্টারগেট’।
তথ্য সূত্র: সিএনএন