পাকিস্তানের সাথে শান্তি আলোচনা ব্যর্থ: সীমান্তে কি তবে যুদ্ধের অশনি সংকেত?

পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের শান্তি আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় সীমান্তে উত্তেজনা আরও বাড়ছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হওয়া এই আলোচনা কোনো সমাধানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।

দুই পক্ষই একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছে, যার ফলে একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চরম হুমকির মুখে পড়েছে।

গত কয়েক সপ্তাহে, বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের জেরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। দুই দেশের মধ্যেকার এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সূত্রপাত হয় ৯ অক্টোবর কাবুলে হওয়া কিছু বিস্ফোরণের পর।

আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করে। এর পরেই দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।

পরে, ১৯ অক্টোবর কাতারের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি হয়, যা বর্তমানে কোনোমতে টিকে আছে।

আফগান সরকারের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ শান্তি আলোচনার ব্যর্থতার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে বলেন, “আলোচনায় পাকিস্তানের দাবিগুলো ছিল অযৌক্তিক এবং এর ফলস্বরূপ আলোচনা সফল হয়নি।

বৈঠকটি শেষ হয়েছে এবং আপাতত আলোচনা স্থগিত।

তিনি আরও জানান, “আমরা এই অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা চাই না, এবং যুদ্ধ আমাদের প্রথম পছন্দ নয়।

তবে, তিনি এও উল্লেখ করেন যে, “যদি যুদ্ধ বাধে, তবে আত্মরক্ষার অধিকার আমাদের আছে।

এদিকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এক সাক্ষাৎকারে জানান, “আলোচনা শেষ হয়েছে” এবং পাকিস্তানি প্রতিনিধি দল কোনো ভবিষ্যৎ বৈঠকের পরিকল্পনা ছাড়াই দেশে ফিরছে।

তিনি আরও যোগ করেন, যুদ্ধবিরতি বহাল থাকবে, যতক্ষণ না আফগান পক্ষ থেকে এর লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

আফগানিস্তানের তালেবান সরকার বরাবরই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

তাদের দাবি, তারা তাদের ভূমি অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেয় না।

২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকেই টিটিপি-র তৎপরতা বেড়েছে।

ইসলামাবাদের অভিযোগ, টিটিপি-কে মদদ জোগাচ্ছে আফগান সরকার।

তবে, জাবিউল্লাহ মুজাহিদ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, টিটিপি-র জন্ম তালেবানের ক্ষমতা দখলের অনেক আগে থেকেই।

ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হওয়া দু’দিনের এই আলোচনা ছিল দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

তুরস্ক ও কাতার এই আলোচনার মধ্যস্থতা করে। কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছাড়াই আলোচনা ভেস্তে যায়।

আলোচনার ব্যর্থতার এক দিন আগে, আফগান কর্মকর্তারা জানান যে সীমান্তের ওপারে সংঘর্ষে চারজন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং আরও পাঁচজন আহত হয়েছে।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আফগান প্রতিনিধি দল কোনো ‘পূর্ব প্রস্তুতি’ ছাড়াই এসেছিল এবং কোনো লিখিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হয়নি।

খাজা আসিফ বলেন, “তারা মৌখিক চুক্তির প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বললেও, এখানে সেই সুযোগ নেই।

তিনি আরও জানান, চতুর্থ দফা আলোচনার কোনো পরিকল্পনা বা সম্ভাবনা নেই। আলোচনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

এর আগে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দাবি করে, তারা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি তালিবানের আস্তানায় বিমান হামলা চালিয়েছে, যাতে বহু সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।

আফগান কর্মকর্তারা এই দাবি অস্বীকার করে জানান, হামলায় বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং এর জবাবে আফগান বাহিনী পাকিস্তানি সামরিক পোস্টে হামলা চালিয়ে ৫৮ জন সেনাকে হত্যা করেছে।

যদিও পাকিস্তান তাদের ২৩ জন সৈন্য নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে।

সীমান্তের এই উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে কাতার উভয় পক্ষকে আলোচনার জন্য দোহায় আমন্ত্রণ জানায়, যেখানে ১৯ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি হয়।

এরপর, ৬ ও ৭ নভেম্বর ইস্তাম্বুলে আলোচনার তৃতীয় দফা অনুষ্ঠিত হয়, যা কোনো ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।

এরই মধ্যে, পাকিস্তান আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের সীমান্ত ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।

যদিও গত সপ্তাহে আটকে পড়া আফগান শরণার্থীদের দেশে ফেরার অনুমতি দিতে প্রধান তোরখাম ক্রসিং আংশিকভাবে খোলা হয়েছিল।

পাকিস্তানের এই পদক্ষেপের ফলে বাণিজ্য ও পরিবহন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়েছে।

সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার কারণে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্য পথটি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।

সীমান্ত নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি, পাকিস্তান বর্তমানে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের, যাদের অধিকাংশই আফগান, তাদের ফেরত পাঠানোর অভিযান চালাচ্ছে।

২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত দশ লক্ষেরও বেশি আফগান নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বেড়েছে, যার বেশিরভাগের দায় টিটিপি স্বীকার করেছে।

টিটিপিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *