ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কি তবে বিলুপ্তির পথে? ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি!

পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন কি তবে ভেঙে যাচ্ছে? ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা সেই সম্ভাবনাকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছে। জাবাল আল-বাবা গ্রামের অধিবাসী আতালাহ মাজারা’আ-এর চোখেমুখে এখন গভীর শঙ্কা।

জেরুজালেমের দিকে চেয়ে থাকা এই বেদুইন গ্রামটি কার্যত পশ্চিম তীরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। কিন্তু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন এখন সুদূর ভবিষ্যতের মতোই অনিশ্চিত।

সম্প্রতি, ইসরায়েলের চরম ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ হাজার হাজার নতুন বসতি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন। এর ফলে, ‘ই-১’ নামে পরিচিত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যত পশ্চিম তীরকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হবে।

স্মোটরিচ স্পষ্ট জানিয়েছেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা। তাঁর মতে, “কথার মাধ্যমে নয়, বরং কাজের মাধ্যমেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আলোচনার টেবিল থেকে সরিয়ে দিতে হবে।”

জাবাল আল-বাবা গ্রামটিসহ প্রায় ২২টি বেদুইন সম্প্রদায়ের প্রায় ৭,০০০ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে রয়েছে। এই গ্রামের নেতা মাজারা’আ জানান, “এই অঞ্চলের ভূমি জবরদখল করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে চান স্মোটরিচ।

আমাদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত, শুধু আমার নয়, প্রতিটি শিশু, নারী এবং সকলের। আমি ভীত।” জাবাল আল-বাবা-তে প্রায় 80টি পরিবার বাস করে, যেখানে প্রায় 450 জন ফিলিস্তিনি বসবাস করে।

এই গ্রামে বসবাসকারী বেদুইনদের জীবনযাত্রা মূলত তাদের প্রায় ৩,০০০ পশুর উপর নির্ভরশীল।

মাজারা’আ তাঁর বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলেন, যেকোনো মুহূর্তে বুলডোজার দিয়ে এগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। তিনি কাছেই অবস্থিত ‘মা’আলে আদুমিম’ ইহুদি বসতির দিকে ইঙ্গিত করেন এবং বলেন, “বেদুইনদের উপস্থিতি প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কিন্তু বসতিগুলো তা নয়।”

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর দখল করে এবং সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন শুরু করে। আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের মতে, এই বসতিগুলো অবৈধ। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশই পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দেখে।

বসতি স্থাপনকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে মনে করা হয়। বর্তমানে, জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের প্রায় ৩ মিলিয়ন ফিলিস্তিনির মধ্যে ৭ লক্ষ ইহুদি বসতি স্থাপনকারী বাস করে।

মাজারা’আ বলেন, “এই পরিবারগুলো ১৯৬৭ সালের আগে থেকেই এখানে বসবাস করছে। বসতি নির্মাণের আগেও তারা এখানে ছিল… একজন বেদুইন হিসেবে, আমার জন্য এই এলাকায় থাকাটা জরুরি। ইসরায়েলের আমার জীবন অন্য কোথাও বেছে নেওয়ার কোনো অধিকার নেই।”

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার সদস্য এবং বেজালেল স্মোটরিচসহ আরও অনেকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনা নস্যাৎ করার পক্ষে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের পক্ষে ওকালতি করেছেন।

জানা গেছে, জুন ২০২৪-এর একটি অডিও বার্তায় স্মোটরিচ বলেছিলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য হুমকি স্বরূপ, তাই ইহুদি বসতি স্থাপন করে এর মোকাবিলা করতে হবে। তাঁর মতে, “লক্ষ্য হলো, বহু বছর ধরে এই ব্যবস্থার ডিএনএ পরিবর্তন করা।”

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর স্মোটরিচ পশ্চিম তীরে বসতিগুলো সংযুক্ত করার প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ইসরায়েলের পার্লামেন্টকে (Knesset) বলেন, ট্রাম্পের জয় “ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ নিয়ে এসেছে।”

স্মোটরিচ আরও যোগ করেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের “হুমকি” দূর করার “একমাত্র উপায় হলো জুডিয়া ও সামারিয়ার (বাইবেলে পশ্চিম তীরের নাম) সব বসতির উপর ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করা।”

জাবাল আল-বাবা গ্রামের দক্ষিণে আল-ইজারিয়া শহর, যা পূর্ব জেরুজালেমের সঙ্গে সংযুক্ত। এখানকার অধিবাসীদের বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত রাস্তা এবং কোলাহলপূর্ণ জীবন দেখা যায়।

বাস্তুচ্যুত হতে যাওয়া কিছু বেদুইনকে এই শহরে চলে যেতে হতে পারে। সেখানকার পৌরসভার এক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাত্তার জানান, বেদুইনদের জন্য এটি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ। জীবিকা নির্বাহের জন্য অপরিচিত পরিবেশ এবং গবাদি পশু চারণের জায়গার অভাব তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে।

ই-১ বসতি নির্মাণের পাশাপাশি, ইসরায়েল আল-ইজারিয়ার ভেতর দিয়ে একটি রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করছে। এই রাস্তা ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা সড়ক ব্যবস্থা তৈরি করবে।

‘পিস নাউ’ নামক একটি সংস্থার মতে, যা বসতি সম্প্রসারণের উপর নজর রাখে, এই রাস্তা নির্মাণের ফলে ফিলিস্তিনিদের চলাচল কার্যত নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

আল-ইজারিয়া জেরুজালেম শহরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘খাবার সরবরাহ কেন্দ্র’। এখানকার বাসিন্দারা জানান, পশ্চিম তীরের সবচেয়ে বড় বাজারটিও এখানেই অবস্থিত, যা উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।

রাস্তা তৈরি হলে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য অন্য কোথাও যেতে হবে, যা খরচ বাড়িয়ে দেবে। এখানকার ব্যবসায়ীরা তাঁদের জীবনভর সঞ্চয় হারানোর ভয়ে ভীত।

আল-ইজারিয়ার এক সুপারমার্কেট ও রেস্তোরাঁর মালিক আব্দুল্লাহ কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, “আমি আমার সব টাকা এখানে বিনিয়োগ করেছি।

যদি তারা এটা ধ্বংস করে দেয়, তবে আমার আর কিছু করার থাকবে না। আমার বয়স ৬৫ বছর। আমি আশা করি তারা এটা করবে না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা আশা করি (যুক্তরাষ্ট্রের) প্রেসিডেন্ট (ডোনাল্ড) ট্রাম্প এতে হস্তক্ষেপ করবেন এবং এটা বন্ধ করবেন।”

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাঁর প্রশাসন ‘ডিল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ নামে একটি পরিকল্পনা পেশ করেছিল। এই পরিকল্পনায় পূর্ব জেরুজালেমের কিছু অংশকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

কিন্তু ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর এই পরিকল্পনা নিয়ে তেমন কোনো কথা বলেননি।

ইসরায়েলি শান্তি কর্মী এবং ‘পিস নাউ’-এর সেটেলমেন্ট ওয়াচের সহ-পরিচালক হাগিত ওফ্রান দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি বসতিগুলোর উপর নজর রাখছেন এবং পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন।

তাঁর মতে, গাজায় ইসরায়েলের প্রায় দুই বছরের হামলা পশ্চিম তীরে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা কঠিন করে তুলেছে। তিনি বলেন, “আমরা গাজায় যুদ্ধ বন্ধ এবং পশ্চিম তীরে দখলদারিত্বের অবসানের জন্য লড়াই করছি। এখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে।”

ই-১ বসতির বাসিন্দাদের চলাচলের সুবিধার জন্য রাস্তা নির্মাণের বিষয়ে ওফ্রান বলেন, এটি কার্যত ফিলিস্তিনিদের জন্য পশ্চিম তীরের কেন্দ্র বন্ধ করে দেবে এবং তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করবে।

ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া হবে এবং তাদের সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করা হবে। তিনি বলেন, “আমি জানি না, তারা কীভাবে তাদের স্বাভাবিক অঞ্চলে প্রবেশ করবে।

এটা এই সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করবে, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি কোনো ধরনের সদিচ্ছা দেখায়নি।”

ফিলিস্তিনের কার্টোগ্রাফার খলিল তুফাকজি ১৯৮৩ সাল থেকে ইসরায়েলি বসতিগুলোর উপর নজর রাখছেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎকে কার্যত শেষ করে দিয়েছে।

তাঁর মতে, “তারা (ইসরায়েলি সরকার) ৭ অক্টোবরের ঘটনা এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সুবিধা নিয়েছে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য।”

দিনের শেষে, জাবাল আল-বাবার টিলার উপরে একটি গাছের নিচে বসে মাজারা’আ তাঁর গ্রামের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি জানেন না, আগামীকাল সকালে এই গ্রামটি তাঁর থাকবে কিনা।

তিনি বলেন, “এটা শুধু আমার জীবন নয়, আমার স্মৃতি এবং শৈশবও। আমি এই এলাকার প্রতিটি কোণা চিনি।”

মাজারা’আ যোগ করেন, “জাবাল আল-বাবা শুধু এখানে বসবাসকারী বেদুইনদের স্বপ্নের সমাপ্তি নয়, বরং ভবিষ্যতের একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিটি ফিলিস্তিনির স্বপ্নেরও সমাপ্তি।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *