প্যারিস অলিম্পিক: শ্রমিকদের স্বপ্নভঙ্গ, প্রতিশ্রুতি কি মিথ্যা?

শিরোনাম: প্যারিস অলিম্পিকের শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ: কাগজবিহীন শ্রমিকদের দুর্দশা

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আসন্ন অলিম্পিক গেমস-এর আগে, ক্রীড়া-উৎসবের চাকচিক্যের আড়ালে চাপা পড়েছে এক শ্রেণির শ্রমিকের বঞ্চনার কাহিনি। অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুত করা ‘আডিডাস অ্যারেনা’ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেক কাগজপত্রবিহীন শ্রমিকদের (ডকুমেন্টবিহীন শ্রমিক) ভাগ্যাকাশে এখনো ঘোর অমাবস্যার ছায়া।

তাঁদের অভিযোগ, কাজের বিনিময়ে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তাঁদের, ভাঙা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি।

২০২৩ সালের ১৭ই অক্টোবর, মুসা* নামের এক নির্মাণ শ্রমিক প্যারিসের ‘আডিডাস অ্যারেনা’র নির্মাণস্থলে ধর্মঘটে যোগ দেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, ফ্রান্সে বসবাসের অনুমতিপত্র (রেসিডেন্সি পারমিট) পাওয়া এবং নিজের মাতৃভূমি মালিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করা।

মুসা জানান, ২০১৯ সালে আলজেরিয়া থেকে স্প্যানিশ নৌকায় করে তিনি ফ্রান্সে আসেন। এরপর থেকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি তাঁর। এমনকি, তাঁর দাদা-দাদীর মৃত্যুর পরও তিনি দেশে ফিরতে পারেননি।

আডিডাস অ্যারেনায় আট মাস ধরে কাজ করার সময় মুসা দৈনিক প্রায় ৭৫ ইউরো (৮৫ ডলার) মজুরি পেতেন, যা ছিল ১০ ঘণ্টার কঠোর পরিশ্রমের তুলনায় খুবই সামান্য। এছাড়াও, পরিবহন খরচ, মাস্কসহ সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের খরচ তো ছিলই।

এই অ্যারেনায় কাজ করতেন প্রায় চার শতাধিক শ্রমিক। মূলত, অন্যের কাগজপত্র ব্যবহার করে তিনি নিয়মিত বেতন পেতেন।

ধর্মঘটের ফলস্বরূপ, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর ১৪ জন শ্রমিকের কাগজপত্র প্রক্রিয়াকরণের জন্য ফরাসি পুলিশের প্রিফেকচারে (স্থানীয় প্রশাসনিক দপ্তর) একটি তালিকা জমা দেওয়া হয়। এই শ্রমিকদের বসবাসের অনুমতি ও স্বাস্থ্য বীমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

প্যারিস সিটি কর্পোরেশন, নির্মাণ সংস্থা বুইগ এবং আরও কয়েকটি সহযোগী সংস্থা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

কিন্তু ঘটনার ১৮ মাস পরেও, শ্রমিকদের আবেদনগুলো এখনো অনুমোদন পায়নি। এমনকি, ১৪ জনের মধ্যে মাত্র একজনের প্রিফেকচারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের মনে এখন বিভিন্ন প্রশ্ন দানা বাঁধছে।

তাঁদের অনেকেই মনে করছেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা হচ্ছে।

আরেক শ্রমিক, আদামা* জানান, “আমরা বেশি কিছু চাইনি, শুধু একটি রেসিডেন্সি পারমিট এবং স্বাস্থ্য বীমা কার্ড চেয়েছিলাম। এটাই তো আমাদের অধিকার। কিন্তু আজও আমরা এই দেশে কাজ করার অধিকার পাইনি।”

শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি শ্রমিক সংগঠন ‘সিএনটি-এসও’ (CNT-SO) -এর আইনজীবী রাফিকা রাহমানি জানান, তাঁরা এক বছর আগে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিয়েছেন।

রাফিকা আরও বলেন, “আমাদের কাছে বেতনের প্রমাণ আছে, সবকিছুই আছে। আমরা নিয়ম মেনেই চলছি। তবুও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা জানি না, কেন ফাইলগুলো এত দিন ধরে আটকে আছে। আমরা দুবার সেগুলো পুনর্বিবেচনার জন্য জমা দিয়েছি।”

আদামা আরও যোগ করেন, “ফ্রান্সে কাগজপত্র ছাড়া থাকাটা যেন জেলখানায় থাকার মতো। কাগজপত্র না থাকলে, যেন কোনো মূল্যই নেই।”

কষ্টের মধ্যেও আদামা ফরাসি ভাষা শেখার জন্য নিয়মিত ক্লাস করেন।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, সিএনটি-এসও ১৩ জন শ্রমিকের আবেদন প্রিফেকচারে পুনরায় জমা দেয়। রাফিকা জানান, “আবেদনগুলো এখনো আটকে আছে।”

তাঁর ধারণা, শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এমনটা করা হচ্ছে। কারণ, শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে অলিম্পিকের আগে ফ্রান্সে শ্রমিকদের খারাপ পরিস্থিতি প্রকাশ্যে এসেছিল।

বামপন্থী দল ‘লা ফ্রান্স ইনসোমিজ’-এর প্রতিনিধি জঁ-ফ্রাঁসোয়া কুলোমে জানান, শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহাল না করার জন্য নির্মাণ সংস্থাগুলো দায়ী। তিনি মনে করেন, ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার কারণে এই শ্রমিকদের একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

কুলোমে আরও জানান, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এই শ্রমিকদের দুর্দশা একটি ব্যাপক সমস্যার উদাহরণ। কুলোমে বলেন, “প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এই শ্রমিকদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে।”

শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য ‘জিলেস নয়ার্স’ নামক একটি সংগঠনও কাজ করছে। এই সংগঠনের মুখপাত্র ডুমস জানান, তাঁরা প্যারিস মেয়র অফিসের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন।

ডুমস আরও বলেন, “আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ১৪ জনের সমস্যার সমাধান হলেও, আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।”

কুলোমের মতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্ভবত এই ফাইলগুলো আটকে রেখেছে। তিনি বলেন, “প্রিফেকচারগুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মেনেই কাজ করে।”

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্যারিস প্রিফেকচারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও, কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় ধরনের আন্তর্জাতিক ইভেন্টের আগে শ্রমিকদের প্রতি নমনীয় আচরণ করা হলেও, সেই উন্মাদনা কমে গেলে প্রতিশ্রুতিগুলো আর রক্ষা করা হয় না।

গবেষক জ্যুলস বয়কফ বলেন, “অলিম্পিকের মতো ঘটনা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সুযোগ তৈরি করে, কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগাতে হয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত অলিম্পিকের আলো ঝলমলে থাকে। এরপর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।”

তবে, অলিম্পিকের মতো বড় ক্রীড়া ইভেন্টগুলো শোষণের সুযোগও তৈরি করে।

বয়কফ বলেন, “অলিম্পিক হলো এমন একটি আয়োজন, যা কিছু মানুষের সুবিধার জন্য তৈরি হয়, যেখানে শ্রমিকদের মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ শোষিত হয়।”

রাফিকা রাহমানি জানান, “ধর্মঘটের সময় অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে, তাঁদের কোনো সাহায্য করা হয়নি।”

ফ্রান্স সরকার অভিবাসন নীতিতে কঠোরতা আরোপ করেছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, ফরাসি পার্লামেন্ট একটি বিতর্কিত অভিবাসন আইন পাস করে, যা কর্মসংস্থানহীন বিদেশিদের জন্য সামাজিক সুবিধা পাওয়া কঠিন করে তোলে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কাগজপত্রবিহীন শ্রমিকদের বৈধ করার সংখ্যা ১০ শতাংশ কমেছে, যেখানে deportations-এর সংখ্যা ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

কুলোমের মতে, এই ধরনের অভিবাসন নীতি বর্তমান সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ডুমস জানান, অভিবাসন এবং বিদেশিদের প্রতি দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।

তথ‌্যসূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *