শরীরচর্চা: পেশী শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি
ছোটবেলায় বাবার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে। একদিকে যেমন বাবার দেওয়া ভালোবাসার আলিঙ্গন, তেমনই ছিল তার কাছ থেকে পাওয়া কিছু কড়া প্রশিক্ষণ।
আমার বাবা, যিনি ১৯৬০-এর দশকে হংকং থেকে নিউইয়র্কে পাড়ি জমিয়েছিলেন, পেশায় ছিলেন একজন শিল্পী এবং কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট। শৈশবে আমরা ভাইবোন দু’জন বাবার স্টুডিওতে ছবি আঁকা এবং কারাতের প্রশিক্ষণ নিতাম।
বাবা বলতেন, “আমি তোদেরকে ছোট্ট নিনজা বানাতে চেয়েছিলাম।” এখন বয়স সত্তরের কাছাকাছি, কিন্তু এখনো তিনি শরীরচর্চা চালিয়ে যান।
ছোটবেলা থেকেই আমি বুঝেছিলাম, শিল্পচর্চা এবং ব্যায়াম—এ দু’য়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পেশী শুধু শরীরের গঠনই সুন্দর করে না, এর অনেক কার্যকরী দিকও আছে।
কারাতে প্রশিক্ষণ আমাদের চালিয়ে যাওয়া হয়নি, কারণ আমরা দু’ভাই-ই মারামারির থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতাম। কিন্তু শারীরিক কার্যকলাপের প্রতি একটা আকর্ষণ সবসময় ছিল।
সাঁতার, লাইফগার্ডের চাকরি, এমনকি সাঁতারের প্রশিক্ষণও দিয়েছি। আমার ভাই যেখানে ফিজিওথেরাপিস্ট হয়েছে, সেখানে আমি বেছে নিয়েছি সাংবাদিকতা।
শরীরের বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং এর গতিময়তা নিয়ে লিখতেই ভালো লাগে।
সাঁতারের প্রতি আমার ভালোবাসা সেই ছোটবেলা থেকেই। তিরিশের কোঠায় পৌঁছে যখন সার্ফিং শিখলাম, জলের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়ার আনন্দটা অনুভব করতে পারতাম।
তবে এর পেছনে কতটা পরিশ্রম করতে হয়, তা আমি বুঝি। এই প্রচেষ্টা আসলে আমাদের জীবনে একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে, যা আমাদের শরীরচর্চার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়।
কয়েক বছর আগে, আমি পেশী নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করি। আমাদের জীবনকে সচল রাখতে পেশীর ভূমিকা কতখানি, তা উপলব্ধি করি।
পেশীর সৌন্দর্য এবং এর তাৎপর্য নিয়ে যখন ভাবি, তখন টলস্টয়ের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে: “আমি স্থিতিশীল জীবনের পরিবর্তে গতিশীলতা চাই।”
আসলে, পেশী আমাদের জীবনের চালিকাশক্তি। হৃদপিণ্ড, খাদ্যনালী থেকে শুরু করে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখতে পেশীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ঐচ্ছিকভাবে আমরা যে পেশী সঞ্চালনে অভ্যস্ত, তার বাইরেও কিছু পেশী আছে যা শরীরের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখে। পেশীগুলো একসাথে কাজ করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে তোলে।
সাম্প্রতিক বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে, পেশী আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পেশী এক ধরনের অন্তঃস্রাবী কলা, যা মস্তিষ্কের মতো শরীরের অন্যান্য অংশে সংকেত প্রেরণ করে।
এই সংকেতগুলি আমাদের জ্ঞানীয় ক্ষমতা, মেজাজ এবং মানসিক আচরণকে প্রভাবিত করে। ব্যায়ামের মাধ্যমে এই ‘মস্তিষ্ক-পেশী সংযোগ’ আরো শক্তিশালী হয়।
ফলে মস্তিষ্কে নতুন নিউরনের সৃষ্টি হয়, যা শেখা এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সহায়ক।
শুধু তাই নয়, পেশীর নিজস্ব স্মৃতিও রয়েছে। পেশী-স্মৃতি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গভঙ্গির পুনরাবৃত্তির স্মৃতি যা আমাদের মোটর নিউরনে সংরক্ষিত থাকে।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন যে, পেশীর মধ্যেও আন্দোলনের স্মৃতি জমা থাকে।
অ্যাডাম শার্পলস, যিনি নরওয়েজিয়ান স্কুল অফ স্পোর্ট সায়েন্সের একজন অধ্যাপক এবং পেশাদার রাগবি খেলোয়াড় ছিলেন, তার গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের কঙ্কাল পেশীর অতীত ব্যায়ামের স্মৃতি রয়েছে।
অর্থাৎ, কিছু জিন সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা ভবিষ্যতে ব্যায়ামের সময় পেশী কোষগুলোকে দ্রুত সাড়া দিতে সাহায্য করে। এমনকি দীর্ঘ বিরতির পরও পেশীগুলো তাদের আগের অবস্থায় ফিরে আসার ক্ষমতা ধরে রাখে।
শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ব্যায়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যায়ামের ফলে শরীরে এমন কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, যা আমাদের জীনকে সক্রিয় করে তোলে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, প্রদাহ কমায় এবং রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পেশী তৈরি করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাঁতার, সার্ফিং বা নাচের মতো আনন্দদায়ক কাজগুলো করার জন্য পেশী শক্তি অপরিহার্য।
আমাদের সবার ক্ষেত্রেই এর সংজ্ঞা আলাদা হতে পারে, কিন্তু মূলনীতি একই। পেশী হলো সম্ভাবনা, শক্তি এবং নিজের শক্তির মালিক হওয়া।
শারীরিক কার্যকলাপের সাথে আনন্দের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শিশুরা যখন হাসে, হাততালি দেয় বা লাফায়, তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ডারউইনও তার ‘দ্য এক্সপ্রেশন অফ দ্য ইমোশনস ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যালস’ বইয়ে আনন্দের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গির এই সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
তবে, সমাজে পেশীর গঠন নিয়ে মানুষের মধ্যে ভিন্ন ধারণা রয়েছে। পেশীবহুল নারীদের প্রায়শই দুর্বল হিসেবে দেখা হয়।
শরীরের গঠন নিয়ে এই ধারণাগুলো ভাঙা দরকার। খেলাধুলা আমাকে আমার শরীরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখিয়েছে।
সাঁতার কাটার কারণে আমার কাঁধ সুগঠিত হয়েছে, পায়ে শক্তি বেড়েছে। আমি আমার শরীরের এই ক্ষমতাকে ভালোবাসি।
আমি মনে করি, শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে আমরা আত্মবিশ্বাসী হতে পারি এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারি।
অতএব, পেশী শুধু শরীরের সৌন্দর্য বাড়ায় না, এটি আমাদের সুস্থ ও আনন্দময় জীবন যাপনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন, পেশীর গুরুত্ব বুঝুন এবং সুস্থ জীবন গড়ুন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান