যুক্তরাষ্ট্রে সীমান্ত নিরাপত্তা পরীক্ষার নামে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস তল্লাশির বিতর্ক
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকালে সীমান্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, যেমন – মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ পরীক্ষা করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মতে, এটি নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার খর্ব করার শামিল।
সম্প্রতি, মিশিগানের আইনজীবী আমির মাকলেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আমির মাকলেদ একজন মার্কিন নাগরিক। তিনি প্রায়ই দেশের বাইরে ভ্রমণ করেন। সম্প্রতি তিনি তার পরিবারের সঙ্গে ডমিনিকান রিপাবলিক থেকে ফিরে আসার সময় ডেট্রয়েট মেট্রো বিমানবন্দরে কাস্টমসের মুখোমুখি হন। সেখানকার সীমান্তরক্ষীরা তাকে এবং তার পরিবারকে একটি বিশেষ কক্ষে নিয়ে যায়।
মাকলেদ বুঝতে পারেন, তাকে সম্ভবত “ট্যাকটিক্যাল টেরোরিস্ট রেসপন্স টিম” (TTRT)-এর কার্যক্রমের অধীনে আনা হয়েছে। মুসলিম-আমেরিকান হিসেবে নিজের প্রতি সন্দেহ ও নজরদারির মানসিকতা কাজ করে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি বুঝতে পারছিলাম, এখানে আমাকে প্রোফাইল করা হচ্ছে।
আইনজীবী হওয়ায় মাকলেদ সীমান্ত কর্মকর্তাদের তার ফোন দিতে রাজি হননি। কারণ, তার ফোনে ক্লায়েন্টদের গোপনীয় তথ্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, আইনজীবী ও মক্কেলের মধ্যে হওয়া গোপন আলোচনাকে সুরক্ষিত রাখতে হয়।
মাকলেদের ফোনের সবকিছু, যেমন – ইমেল, টেক্সট মেসেজ, ফাইল এবং অফিসের জন্য ব্যবহৃত ক্লাউড-ভিত্তিক সফটওয়্যার— সবকিছুই ছিল তার ফোনে।
অবশেষে, তিনি কর্মকর্তাদের তার পরিচিতি তালিকা দেখার অনুমতি দেন, কিন্তু ফোনের অন্য কোনো অংশে প্রবেশ করতে দেননি। প্রায় ৯০ মিনিট পর তাকে ফোনসহ বিমানবন্দর ত্যাগ করতে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনানুসারে, সীমান্তরক্ষীরা কোনো ব্যক্তিকে দেশটিতে প্রবেশের সময় তার জিনিসপত্র তল্লাশি করতে পারেন। এই আইনের ভিত্তি হলো “টাইটেল ১৯”। কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইসে বর্তমানে অনেক বেশি ব্যক্তিগত তথ্য থাকে, যা একজন ব্যক্তির ভ্রমণের সঙ্গে সম্পর্কিত নাও হতে পারে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরে সীমান্তরক্ষীরা প্রায় ৪৭,০৪৭টি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস পরীক্ষা করেছেন। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪১,৭৬৭। এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
এই ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়রানির অভিযোগও উঠেছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে, অ্যাপলের একজন কর্মী আন্দ্রেয়াস গালকে বিদেশ থেকে ফেরার সময় একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
তিনিও তার ডিভাইস পরীক্ষা করতে দিতে রাজি হননি। পরবর্তীতে তিনি জানান, অনলাইনে রাজনৈতিক মত প্রকাশের কারণে তাকে হয়রানি করা হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন।
সম্প্রতি, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে এই ধরনের পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচক এবং ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়— এমন বিদেশিদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে তাদের ডিভাইস থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ রশা আলাউয়েকে তার ফোন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার ফোনে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর ছবি ছিল বলে জানা যায়।
তবে, ট্রাম্প প্রশাসন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, ফরাসি এক গবেষকের ডিভাইস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গোপন তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, যা তিনি প্রকাশ করতে বাধ্য ছিলেন না।
ডিভাইস পরীক্ষার ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়: একটি হলো ‘লাইট’ সার্চ, যেখানে কর্মকর্তারা ডিভাইসটি হাতে পরীক্ষা করেন। অন্যটি হলো ‘অ্যাডভান্সড’ সার্চ, যেখানে বাইরের যন্ত্রপাতির সাহায্য নেওয়া হয়। ‘অ্যাডভান্সড’ সার্চের জন্য কর্মকর্তাদের ‘যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ’-এর প্রমাণ দিতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্ত অঞ্চলে ডিভাইস পরীক্ষার এই পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী লঙ্ঘন করে। চতুর্থ সংশোধনীতে, সরকারের অযৌক্তিক অনুসন্ধান ও আটকের বিরুদ্ধে নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তবে, ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশনের সিনিয়র স্টাফ অ্যাটর্নি সাইরা হোসেনের মতে, ডিজিটাল ডিভাইস পরীক্ষার সীমা কতটুকু হবে, সে বিষয়ে এখনও আদালতের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আইনজীবী আমির মাকলেদ মনে করেন, তার সঙ্গে যা ঘটেছে, তা ছিল তাকে ভয় দেখানোর একটি কৌশল। তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এটা আমাকে এই ধরনের মামলা নেওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা