ঐতিহাসিক! শূকরের লিভার প্রতিস্থাপন, চিকিৎসা জগতে আলোড়ন!

শিরোনাম: শূকর থেকে মানবদেহে যকৃত প্রতিস্থাপন: নতুন দিগন্তের সূচনা?

চীনের চিকিৎসকরা প্রথমবারের মতো একটি যুগান্তকারী পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন, যেখানে জেনেটিক পরিবর্তন করা একটি শূকরের যকৃত (Liver) মানবদেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই ঘটনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

গত বছর, ব্রেন-ডেড (মস্তিষ্ক মৃত) একজন রোগীর দেহে এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্রতিস্থাপিত যকৃতটি মানবদেহে ১০ দিন পর্যন্ত ভালোভাবে কাজ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শরীরে কোনো ইমিউন-প্রতিরোধ অথবা প্রদাহের লক্ষণ দেখা যায়নি।

চীনের জিংজিং হাসপাতালের হেপাটোবিলিয়ারি সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক এবং গবেষণাপত্রের সহ-লেখক ড. লিন ওয়াং এই সাফল্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছেন, “এটা একটা বিরাট অর্জন।”

বর্তমানে বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য মানুষের চাহিদা অনেক বেশি, যেখানে সরবরাহ সে তুলনায় খুবই কম। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এক লক্ষেরও বেশি মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বিকল্প পথ খুঁজছেন। শূকরের অঙ্গ মানবদেহের জন্য উপযোগী কিনা, তা নিয়েও গবেষণা চলছে। কারণ, শূকরের অঙ্গের গঠন মানুষের অঙ্গের কাছাকাছি।

এর আগে, বাইরের একটি যন্ত্রের মাধ্যমে (external liver perfusion) জিন-সম্পাদিত শূকরের যকৃত ব্যবহার করে পরীক্ষা চালিয়েছিল পেন মেডিসিন। সেখানেও ভালো ফল পাওয়া গিয়েছিল। পরীক্ষাগারে, একটি শূকরের যকৃত রোগীর দেহের বাইরে রেখে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত পরীক্ষা চালানো হয় এবং কোনো ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি হয়নি।

যকৃত প্রতিস্থাপন অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। হৃদপিণ্ড যেখানে শুধু রক্ত পাম্প করার কাজ করে, কিডনির প্রধান কাজ হলো প্রস্রাব তৈরি করা, সেখানে যকৃতের কাজ অনেক। এটি রক্তের দূষিত পদার্থ অপসারণ করে, খাদ্য উপাদান প্রক্রিয়াকরণ করে, অ্যালকোহল ও ওষুধের মতো ক্ষতিকর উপাদানকে ডিটক্সিফাই করে, হজমে সহায়ক পিত্ত তৈরি করে, রক্তের জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করে এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।

ড. ওয়াং বলেন, “যকৃতের কাজগুলো খুবই জটিল। তাই, এর প্রতিস্থাপনও কঠিন।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাস জেনারেল ব্রাইগহ্যামের ইন্টিগ্রেটেড ডিপার্টমেন্ট অব সার্জারির বিভাগীয় প্রধান এবং এই ধরনের অঙ্গ প্রতিস্থাপনে বিশেষজ্ঞ ড. শিমুল শাহ মনে করেন, মানুষের শরীরে পশুর অঙ্গ প্রতিস্থাপন একটি জটিল প্রক্রিয়া।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, যকৃত আকারে বড় এবং এতে দুটি উৎস থেকে রক্ত সরবরাহ হয়: একটি হলো হেপাটিক ধমনি, যা অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে, এবং অন্যটি হলো পোর্টাল শিরা, যা পরিপাকতন্ত্র থেকে পুষ্টিসমৃদ্ধ রক্ত নিয়ে আসে।

ডা. শাহ আরও বলেন, “কিডনি এবং হৃদযন্ত্রের ক্ষেত্রে আমরা ভালো ফল পেয়েছি। এমনকি, ফুসফুসের ক্ষেত্রেও আমরা সাফল্যের কাছাকাছি। তবে যকৃতের ক্ষেত্রে আরও কিছুটা সময় লাগবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানব পরিষেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে ৯ হাজারের বেশি মানুষ যকৃত প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় ছিলেন। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমান রোগীর সংখ্যার দিক থেকে কিডনির পরেই যকৃতের স্থান।

যদি শূকরের যকৃত সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা যায়, তবে গুরুতর লিভার ফেইলিওরের (যকৃত বিকল) রোগীদের জন্য এটি একটি বড় অগ্রগতি হবে। এমনকি, মানুষের শরীর থেকে অঙ্গ পাওয়ার জন্য এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবেও কাজ করতে পারে।

নতুন এই পরীক্ষাটি মার্চ ২০২৪ সালে চীনে করা হয়েছিল। শূকরের যকৃতকে মানুষের শরীরের উপযোগী করতে বিজ্ঞানীরা বামা প্রজাতির শূকরের যকৃতে ৬টি জিনগত পরিবর্তন এনেছিলেন।

চিকিৎসকরা যখন রোগীর শরীরে শূকরের যকৃত স্থাপন করেন, তখন তারা রোগীর নিজের যকৃতও বহাল রেখেছিলেন। ড. ওয়াংয়ের মতে, শূকরের যকৃত মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করতে পারবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

চীনের গবেষক দল এর আগে মানবদেহের যকৃত অপসারণ করে শূকরের যকৃত প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেছেন, তবে সেই পরীক্ষার বিস্তারিত তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

নতুন প্রকাশিত পরীক্ষায়, পরিবারের অনুরোধে ১০ দিন পর পরীক্ষাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ড. ওয়াং আরও জানান, এই গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের সার্জনদের কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা এবং তাদের নিজস্ব পশুদের ওপর করা পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। ২০১৩ সালে, ড. ওয়াং এবং তার সহকর্মীরা চীনে প্রথম শূকরের যকৃত একটি বানরের শরীরে প্রতিস্থাপন করতে সফল হয়েছিলেন, যা ১৪ দিন পর্যন্ত টিকে ছিল। তারা শূকর থেকে বানরের হৃদপিণ্ড, কিডনি, চোখের কর্নিয়া, ত্বক এবং হাড় প্রতিস্থাপনও করেছেন।

ড. ওয়াং আরও জানিয়েছেন, তারা সম্প্রতি একটি শূকরের কিডনি মানবদেহে প্রতিস্থাপন করেছেন এবং রোগী খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন।

ডা. শিমুল শাহ, যিনি বর্তমানে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনে সফল একটি দলের সঙ্গে কাজ করছেন, তিনি মনে করেন, যকৃতের ক্ষেত্রে এখনো আরও অনেক কাজ করার প্রয়োজন। তিনি বলেন, “এই গবেষণা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে কীভাবে যকৃত প্রতিস্থাপনে আরও উন্নতি করা যায়। কারণ, আমাদের এ ধরনের আরও গবেষণা প্রয়োজন।”

ইউটি সাউথওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টারের প্রধান সার্জন ড. পার্সিয়া ভ্যাগেফি বলেছেন, এই ধরনের ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে চিকিৎসকরা সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে প্রত্যেক нуждаগ্রস্ত মানুষ একটি অঙ্গ প্রতিস্থাপন পাওয়ার সুযোগ পাবে।

ডা. ভ্যাগেফি আরও যোগ করেন, “এই গবেষণা প্রমাণ করে যে এটি রোগীদের জন্য একটি সহায়ক ব্যবস্থা হতে পারে।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *