ওকালানের ডাকে পিকেকের অস্ত্র বিরতি: অবশেষে কি শান্তির পথে তুরস্ক?

তুরস্কে কুর্দি শ্রমিক পার্টি (পিকেকে)-এর সশস্ত্র সংগ্রামের অবসান হতে চলেছে। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর পর এই ঘোষণা এসেছে।

কুর্দি নেতা আবদুল্লাহ ওকালান, যিনি ‘অ্যাপো’ নামে পরিচিত, তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলটি অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি হয়েছে। খবরটি এমন এক সময়ে এসেছে যখন তুরস্কের ভেতরে ও বাইরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।

পিকেকে-কে একসময় তুরস্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা দীর্ঘদিন ধরে কুর্দি স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করেছে। এখন সেই লড়াই বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আবদুল্লাহ ওকালান ১৯৪৮ সালের ৪ এপ্রিল তুরস্কের সানলিউরফা প্রদেশের ওমেরলিতে এক দরিদ্র কুর্দি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। সেখানেই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হন এবং কুর্দি জনগোষ্ঠীর অধিকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন।

১৯৭৮ সালে তিনি পিকেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে, ওকালানের নেতৃত্বে পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে।

ওকালানের একচ্ছত্র নেতৃত্বে পিকেকে কুর্দি মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়। আলিজা মার্কাসের লেখা ‘ব্লাড অ্যান্ড বিলিফ: দ্য পিকেকে অ্যান্ড দ্য কুর্দিশ ফাইট ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স’ বই অনুসারে, ওকালান অন্যান্য কুর্দি গোষ্ঠীগুলোকে দমন করে কুর্দি মুক্তি সংগ্রামের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।

একসময় কুর্দিদের তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলা, শিশুদের কুর্দি নাম রাখা বা জাতীয়তাবোধ প্রকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো।

ওকালানের স্বৈরাচারী শাসন সত্ত্বেও, তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং কুর্দি অধিকারের পক্ষে অবস্থান তুরস্কের অধিকাংশ কুর্দিকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। তাঁরা ‘অ্যাপো’ নামে তাঁকে ডাকত, যার অর্থ ‘কাকা’।

১৯৮৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সংঘটিত সহিংসতায় ৪০,০০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়। হাজার হাজার কুর্দি তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তর দিকের শহরগুলোতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

১৯৮০ ও ৯০ এর দশকে ওকালান প্রতিবেশী সিরিয়া থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতেন, যা তৎকালীন আসাদ সরকারের সঙ্গে তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করত। পিকেকে ১৯৮০-এর দশকের শেষ এবং ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে নৃশংস কৌশল অবলম্বন করে।

ইউরোপীয় কাউন্সিলের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওকালানের অধীনে পিকেকে বিদেশি পর্যটকদের অপহরণ, আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং ইউরোপে তুর্কি কূটনৈতিক কার্যালয়ে হামলা চালায়। এমনকি পিকেকে গেরিলা যুদ্ধে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করা কুর্দি বেসামরিক নাগরিকদের ওপরও নিপীড়ন চালিয়েছিল।

১৯৯৮ সালে ওকালানকে তুরস্কের হাতে বন্দী হওয়ার আশঙ্কায় সিরিয়া ছাড়তে হয়। এক বছর পর, মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কেনিয়ার নাইরোবিতে বিমানে থাকা অবস্থায় তুর্কি এজেন্টরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

তাঁকে তুরস্কে ফিরিয়ে আনা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে, তুরস্ক ২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার পর তাঁর সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তন করা হয়।

২০১৩ সাল নাগাদ ওকালান বিচ্ছিন্নতাবাদের অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং তুরস্কে কুর্দি অধিকার এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য তদবির শুরু করেন। তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

এই পরিবর্তনের ফলে পিকেকে এবং তুরস্কের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি)-এর মধ্যে একটি দুর্বল শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।

যদিও শান্তি প্রক্রিয়া কিছু কুর্দি স্বাধীনতা এনেছিল, ২০১৫ সালে সরকারের সঙ্গে পিকেকের মধ্যে আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, পিকেকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে একটি কুর্দি রাষ্ট্র তৈরি করতে চাইছে।

ওই সময়ে, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক কুর্দি সিরিয়ায় গিয়ে আইএসআইএস (ISIS)-এর বিরুদ্ধে কুর্দিদের সাহায্য করেছিল।

২০১৫ সালে, একে পার্টি কট্টর-ডানপন্থী ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি (এমএইচপি)-এর সঙ্গে একটি নতুন জোট গঠন করে, যারা পিকেকে-র সঙ্গে কোনো শান্তি প্রক্রিয়ার বিরোধী ছিল।

পিকেকে তাদের অস্ত্র ত্যাগের ঘোষণার সময় জানায়, তারা ‘আমাদের জনগণের অস্বীকৃতি ও ধ্বংসের নীতি ভেঙে দিয়েছে এবং কুর্দি সমস্যাকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে সমাধানের দিকে নিয়ে এসেছে’ এবং তাদের ঐতিহাসিক মিশন সম্পন্ন করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। তুরস্ক এবং ইউরোপ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ব্রাসেলসের কার্নেগি ইউরোপের সিনিয়র ফেলো সিনান উলগেন বলেছেন, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের কারণে পিকেকে এবং এই অঞ্চলের কুর্দি মিত্ররা আগের চেয়ে বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়াকে পররাষ্ট্রনীতির ‘কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে দেখেন না, তাই তিনি আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে যে সমর্থন দিয়েছিলেন, তা সম্ভবত অব্যাহত রাখবেন না।

এছাড়াও, সিরিয়ার নতুন সরকার তুরস্কের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখছে, যা আগে আসাদ সরকারের অধীনে ছিল না। এই নতুন সম্পর্ক পিকেকে এবং এর সিরীয় শাখা ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি)-র সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তে কার্যক্রম পরিচালনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এখন পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একে পার্টি এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি)-র মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে বা গোপনে একটি নতুন শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেছে।

তবে, এমএইচপি, যারা দীর্ঘদিন ধরে কুর্দিদের প্রতি কোনো ধরনের নমনীয়তার বিরোধিতা করেছে, তারাই সম্ভবত নতুন শান্তি প্রক্রিয়ার পথ খুলে দিয়েছে।

এপ্রিল ২০২৪-এ, এমএইচপি নেতা দেভলেট বাহচেলি ওকালানকে তুরস্কের পার্লামেন্টের সামনে ‘সন্ত্রাসবাদ’ ত্যাগ করার আহ্বান জানান, যার বিনিময়ে তাঁর প্যারোলের সম্ভাবনা থাকতে পারে। জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স (এসডব্লিউবি)-এর তুরস্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সিনেম আদার বলেন, ‘বাহচেলির এই পদক্ষেপ ছিল অবিশ্বাস্য।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাহচেলির এই অবস্থান পরিবর্তনের মূল কারণ সম্ভবত তাঁর জোটসঙ্গী এরদোয়ানকে আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হতে সহায়তা করা। সংবিধান অনুসারে, এরদোয়ান আগাম নির্বাচন আহ্বান করা না হলে আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

এর জন্য পার্লামেন্টের ৬০০ ভোটের মধ্যে ৩৬০টি ভোটের প্রয়োজন। কার্নেগির উলগেন বলেছেন, ‘এরদোয়ানকে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের বাইরেও পার্লামেন্টে তাঁর রাজনৈতিক সমর্থন বাড়াতে হবে।

উলগেন আরও বলেন, ওকালানকে মুক্তি দেওয়া হবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে তাঁর কারাবাসের পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হতে পারে। তাঁর সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে সরকার ধীরে ধীরে ওকালানের স্বাধীনতা বাড়াতে চাইবে।

তুরস্কে এখনো অনেক মানুষ ওকালানকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে মনে করে এবং এত মানুষের মৃত্যুর জন্য তাঁকেই দায়ী করে। উলগেন বলেন, ‘সরকার সম্ভবত ওকালানকে মুক্তি দেওয়ার আগে পরিস্থিতি যাচাই করতে চাইছে।’

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *