প্লাস্টিক দূষণ: এক ভয়াবহ চিত্র, বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত
প্লাস্টিক, যা এককালে আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত, আজ পরিবেশের জন্য এক চরম উদ্বেগের কারণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার ব্যাপক, কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলি ক্রমশ আমাদের গ্রাস করছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, প্লাস্টিকের ভয়াবহতা কেবল একটি বৈশ্বিক সমস্যাই নয়, এটি আমাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। আসুন, প্লাস্টিকের কিছু ভয়ঙ্কর তথ্য জেনে নেওয়া যাক, যা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অশনি সংকেতস্বরূপ।
- খাদ্যে প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ: গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যে পরিমাণ সামুদ্রিক মাছ খাই, তার প্রায় ৯৯ শতাংশেই প্লাস্টিকের কণা বিদ্যমান। শুধু মাছ নয়, চিংড়ি, কাঁকড়ার মতো বিভিন্ন জলজ প্রাণীর শরীরেও এই মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করছে। এমনকি, খাবার গরম করার সময় প্লাস্টিকের প্যাকেজিং থেকেও এই কণা খাবারে মিশে যাচ্ছে।
- ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক: প্রতি বছর, একজন মানুষ খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে প্রায় ৩৮ লক্ষ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করে। বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন যে এই ক্ষুদ্র কণাগুলোর স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটা গুরুতর, তবে এর প্রভাব যে মারাত্মক হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য।
- পুনর্ব্যবহারের ব্যর্থতা: প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। উৎপাদিত প্লাস্টিকের মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয়।
- সমুদ্রে প্লাস্টিকের প্রবেশ: প্রতি ৬০ সেকেন্ডে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হচ্ছে।
- সমুদ্রে জমা হওয়া প্লাস্টিক: বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি মিনিটে কমপক্ষে দুটি ট্রাক ভর্তি করে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হবে।
- প্লাস্টিকের ভাগাড়: বিশাল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য, বিশেষ করে “গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ”-এর মতো স্থানে জমা হচ্ছে, যা হাওয়াই ও ক্যালিফোর্নিয়ার মাঝামাঝি অঞ্চলে অবস্থিত।
- সমুদ্রে প্লাস্টিকের বিস্তার: সমুদ্রে ৫ ট্রিলিয়নেরও বেশি প্লাস্টিকের টুকরা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ ৬৯ হাজার টন প্লাস্টিক সমুদ্রের উপরিভাগে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে।
- গভীর সমুদ্রের দূষণ: গভীর সমুদ্রে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৪ বিলিয়নেরও বেশি প্লাস্টিক মাইক্রোফাইবারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
- সামুদ্রিক জীবনের ক্ষতি: প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী প্রায়ই প্লাস্টিক গ্রহণ করে। অনেক পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিকের জালে আটকা পড়ে মারা যায়। প্রতি বছর প্রায় ১ লক্ষ সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিকের কারণে মারা যায়।
- উপকূলের দূষণ: বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতে পাওয়া যাওয়া বর্জ্যের প্রায় ৭৩ শতাংশই প্লাস্টিক। হাওয়াই দ্বীপের কামিলো বিচ এর একটি উদাহরণ, যেখানে টিভির পিছনের অংশ পর্যন্ত ভেসে আসে!
- প্লাস্টিক ও জীববৈচিত্র্য: গবেষণায় দেখা গেছে, ৮১ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর জীবনযাত্রায় প্লাস্টিকের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এমনকি একটি স্পার্ম তিমি (sperm whale)-র ময়নাতদন্তে প্রায় ৩০ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা তার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ছিল।
- একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের আধিক্য: উৎপাদিত প্লাস্টিকের ৪০ শতাংশই একবার ব্যবহার করার জন্য তৈরি করা হয়।
- প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার: বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়।
- জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার: উদ্বেগের বিষয় হল, ৯৮ শতাংশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে।
- জলবায়ু পরিবর্তন: ধারণা করা হচ্ছে, প্লাস্টিক উৎপাদন, ব্যবহার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস ২০৪০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক কার্বন বাজেটের ১৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
- মানবদেহে প্লাস্টিক: ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের সমুদ্রতীরে ভেসে আসা ১০০ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এমনকি ২০২২ সালে, প্রথমবারের মতো মানুষের রক্তেও প্লাস্টিকের কণা শনাক্ত করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের একটি গবেষণায় ২২ জনের মধ্যে ১৭ জনের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
এই ভয়াবহ চিত্র থেকে বোঝা যায়, প্লাস্টিক দূষণ একটি জরুরি সমস্যা। আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। “প্লাস্টিক-মুক্ত জুলাই” (Plastic-Free July)-এর মতো সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং “প্লাস্টিক পজিটিভ” (Plastic Positive)-এর মতো আন্দোলনে আমাদের আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। কাগজের স্ট্র-এর ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে পরিবর্তন আনা। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায়, আমরা হয়তো অচিরেই প্লাস্টিকের সমুদ্রে নিমজ্জিত হব।
তথ্য সূত্র: Travel and Leisure