পাপুয়া নিউ গিনির গভীর অরণ্যে বাস করা কিছু পাখির শরীরে এমন এক বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গেছে যা কিনা সাইনাইডের চেয়েও মারাত্মক। বিজ্ঞানীরা এই পাখিগুলোর জীবনযাত্রা এবং তাদের শরীরে এই বিষের উৎস সম্পর্কে জানতে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর একটি প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৮৯ সালের গ্রীষ্মকালে, জ্যাক ডাম্বাচার নামের এক তরুণ পক্ষীবিদ পাপুয়া নিউ গিনির ঘন জঙ্গলে প্রথমবার অভিযান চালান। একদিন, তিনি তার জাল থেকে একটি অদ্ভুতদর্শন পাখি উদ্ধার করতে যান, যার শরীরে ছিল কালো ও কমলা রঙের উজ্জ্বল পালক। পাখিটিকে মুক্ত করতে গিয়েই বিপত্তি! পাখিটি তাকে ঠুকর মারে।
তাৎক্ষণিকভাবে তার ঠোঁটে জ্বালা অনুভব করেন ডাম্বাচার। পরে স্থানীয় গাইডদের সাথে কথা বলে তিনি জানতে পারেন, গ্রামবাসীরা এই পাখিগুলোকে “আবর্জনা পাখি” হিসেবে এড়িয়ে চলে। এমনকি, চামড়া ছাড়িয়ে বিশেষ প্রক্রিয়াকরণের পরেই কেবল তারা এই পাখির মাংস খান।
এরপর ডাম্বাচার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান এবং এক বছর ধরে এই পাখির নমুনা সংগ্রহ করেন। তিনি এর বিষের উৎস অনুসন্ধানের জন্য একজন রসায়নবিদের সাহায্য নেন।
১৯৯২ সালে ডাম্বাচার এবং তার সহকর্মীরা তাদের গবেষণার ফল প্রকাশ করেন। তারা জানান, এই পাখির শরীরে “ব্যাট্রাকোটক্সিন” নামক এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে। এটি সাইনাইডের চেয়েও মারাত্মক এবং প্রাণীজগতের অন্যতম বিষাক্ত উপাদান।
এই একই বিষ পাওয়া যায় বিষাক্ত “পয়জন ডার্ট” ব্যাঙের শরীরেও। ডাম্বাচারের এই আবিষ্কারের পর, বিজ্ঞানীরা আরও অনেক পাখির প্রজাতিতে এই বিষের সন্ধান পেয়েছেন।
এদের মধ্যে অন্যতম হলো ইউরোপীয় কোয়েল, উত্তর আমেরিকার রুফড গ্রাউস এবং ইউরোপীয় হুপোয়েস। এদের অধিকাংশই ব্যাট্রাকোটক্সিন বহন করে এবং পাপুয়া নিউ গিনির আশেপাশে এদের বসবাস। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত এই ধরনের অন্তত এক ডজনের বেশি পাখি শনাক্ত করেছেন।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না, এই পাখিরা কীভাবে এই মারাত্মক বিষ থেকে নিজেদের রক্ষা করে। ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর পাখি ও স্তন্যপায়ী বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক জ্যাক ডাম্বাচার বলেন, “পাখিগুলোর বাস্তুবিদ্যা, কীভাবে তারা আত্মরক্ষার জন্য ব্যাট্রাকোটক্সিন ব্যবহার করে, এবং তারা কোথা থেকে এই বিষ পায় – এই বিষয়গুলো এখনো আমাদের কাছে অজানা।
এই বিষয়ে গবেষণা এখনো চলছে। সুইডিশ মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরি-এর বাস্তুবিজ্ঞানী নুড জনসন এবং কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী কাসুন বোদাওয়াট্টা-এর নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাপুয়া নিউ গিনিতে অনুসন্ধান চালাবেন। ২০২৩ সালে তারা আরও দুটি নতুন বিষাক্ত পাখির প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন।
গবেষকদের প্রধান প্রশ্ন হলো, এই বিষের উৎস কী? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, খাদ্যাভ্যাসই সম্ভবত এর কারণ। জনসন বলেন, “ধারণা করা হয়, এই পাখিরা ‘কোরিসিন’ নামের এক ধরনের বিটল (পোকা) খায় এবং তা থেকেই তারা বিষ সংগ্রহ করে। তবে আমরা এখনো নিশ্চিত নই।
ডাম্বাচার মনে করেন, পোকামাকড় থেকে এই বিষ আসে না। সম্ভবত মাটি থেকে পাওয়া কোনো উপাদান বা অন্য কোনো উৎস থেকে বিটল এই বিষ সংগ্রহ করে। বিজ্ঞানীরা এখন বিষাক্ত পাখি সংগ্রহ করে তাদের পাকস্থলীতে থাকা খাদ্যের সাথে পোকামাকড় পরীক্ষা করে দেখছেন।
জার্মানির সারল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ ক্রিস্টিন বিমেলম্যানস এই নমুনাগুলো থেকে ব্যাট্রাকোটক্সিন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন। পাখিরা কীভাবে এই বিষের প্রভাব থেকে নিজেদের বাঁচায়, তা এখনো একটি রহস্য।
ব্যাট্রাকোটক্সিন স্নায়ু, পেশি এবং হৃদপিণ্ডের কোষের “সোডিয়াম আয়ন চ্যানেল”-এর সাথে যুক্ত হয়ে অবশতা, খিঁচুনি, পক্ষাঘাত এবং এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, বিষাক্ত পাখিদের সোডিয়াম চ্যানেলে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যার ফলে বিষ তাদের ক্ষতি করতে পারে না।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোর জীবপদার্থবিদ ড্যানিয়েল মাইনর মনে করেন, সম্ভবত পাখিদের শরীরে এমন একটি প্রোটিন রয়েছে যা “বিষাক্ত স্পঞ্জ”-এর মতো কাজ করে, যা ব্যাট্রাকোটক্সিনকে আবদ্ধ করে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে।
জনসন ও বোদাওয়াট্টা মনে করেন, দুটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে কাজ করতে পারে। তাদের মতে, “পাখিদের অবশ্যই এমন একটি প্রোটিন থাকতে হবে যা অন্ত্র থেকে চামড়ার মাধ্যমে ব্যাট্রাকোটক্সিন পরিবহনে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীরা আরও জানতে চান, বিশ্বে আর কোনো বিষাক্ত পাখি আছে কিনা। জনসন মনে করেন, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তিনি জানান, পাপুয়া নিউ গিনির বিষাক্ত পাখিগুলো “কোরভিডি” নামক পাখির একটি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে সারা বিশ্বে প্রায় ৭০০ প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে ১৪০টির বেশি প্রজাতি কেবল পাপুয়া নিউ গিনিতেই পাওয়া যায়।
নভেম্বরে তার দল দ্বীপটির বিভিন্ন স্থান থেকে আরও নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোর পরীক্ষা চালাবেন। বোদাওয়াট্টা আরও যোগ করেন, বিজ্ঞানীরা এই “আশ্চর্যজনক এবং অসাধারণ” অভিযোজন (convergent evolution) নিয়ে গবেষণা করতে চান। এই অভিযোজন উভচর এবং অন্যান্য পাখির প্রজাতিকে কীভাবে এই বিষাক্ততার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, তা তারা জানতে চান।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই গবেষণা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বোদাওয়াট্টা বলেন, “আমরা হয়তো আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে নতুন কিছু তথ্য জানাতে পারব। এটা কেবল শুরু।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক